দিল্লিতে সাভারকরের নামে সরকারি কলেজ। হিন্দুত্ব ও মেরুকরণের রাজনীতিকে নতুন করে মাইলেজ দিল কেন্দ্রীয় শাসক দল।
দিল্লির বিধানসভা ভোটের মুখে ফের হিন্দুত্বের তাস খেলতে তৎপর বিজেপি। রাজধানীর বুকে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের নামে সরকারি কলেজ চালু করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
অান্দামান থেকে ফিরে মহারাষ্ট্রর রত্নগিরি জেলে বসে ‘হিন্দুত্ব’ নামে একটি বই লেখেন সাভারকর– হিন্দু জাতীয়তাবাদের আকর গ্রন্থ ধরা হয় এটিকে। সাভারকরের তত্ত্ব থেকেই জন্ম নেয় ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-র ধারণা। যার হাত ধরে আসে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’। ব্যক্তিজীবনে আদ্যন্ত নাস্তিক সাভারকর রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রবক্তা। ফলে, সাভারকরের নামে সরকারি কলেজ খোলা মানে শুধুমাত্র একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে স্বীকৃতি দেওয়া– এইভাবে বিষয়টি দেখার সুযোগ নেই।
মুচলেকা দিয়ে সাভারকরের আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে চলে আসার বিতর্ক দূরে সরিয়ে রাখলেও তাঁর ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ব’-র জনক পরিচিতি কখনও অস্বীকার করা যায় না। তিনি যে বিজেপি-আরএসএসের তাত্ত্বিক গুরু, তা নিয়েও বিতর্কের অবকাশ নেই। ভোটের আগে সাভারকরকে ময়দানে টেনে আনা হিন্দুত্ব আবেগকে চাগিয়ে দেওয়াই। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের দাবি, হিন্দুত্বর ধ্বজাধারীদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা না-দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লির এই সরকারি কলেজটি সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নামে বানাতে পারত।
দাবিটি যুক্তিসংগত। সাভারকরের মৃতু্য হয়েছে ১৯৬৬ সালে। সুতরাং তঁার নামে দিল্লিতে অাগেই কলেজ তৈরি করতে পারত বিজেপি। হঠাৎ ভোটের মুখে সাভারকরকে টেনে আনা অপ্রয়োজনীয়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানিয়েছেন, সিদ্ধান্তটা ২০২১ সালের। যদি ২০২১ সালের সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে ভোটের মুখে কেন তা রূপায়িত করা হচ্ছে? সময়ের দাবি মেনে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত বদল করা প্রয়োজন ছিল।
২০০২ সালে বাজপেয়ী আমলে আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারের বিমানবন্দর সাভারকরের নামে করা হয়। এছাড়া দেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নামকরণ তাঁর নামে হয়। নতুন করে দিল্লিতে তাঁর নামে কলেজ না-করলেও সাভারকরের অবদান ছোট হত না। সাভারকরের বীরত্বও খাটো হত না। কিন্তু মনমোহন সিংয়ের নামে এই সময় সরকারি কলেজ হলে সরকারেরই মুখ উজ্জ্বল হত। বিদ্বান অর্থনীতিবিদ হিসাবে মনমোহনের নাম তাঁর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বা প্রথম শিখ প্রধানমন্ত্রী পরিচয়কে ছাপিয়ে যায়।
মনমোহন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অক্সফোর্ড থেকে ফিরে দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্সে অধ্যাপনা করেন। ফলে শিক্ষাবিদ মনমোহনের সঙ্গে দিল্লির যোগ নিবিড়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ ছিল ভারতের অার্থিক সংস্কারের রূপকারকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার। সেই পথে না-হেঁটে তারা বিজেপির সংকীর্ণ রাজনীতির ঘুঁটি হয়ে গেল। ভোটের আগে কেন সাভারকরের নামে সরকারি কলেজ হল, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক যত সামনে আসবে, তত বিজেপি তার ‘রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক হিন্দুত্ব’ প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে। হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন ও তদ্জনিত মেরুকরণের সুবিধা হবে।