নির্মল ধর: বের্টল্ট ব্রেখট সেই কবে ‘আর্তুরো উই’ নামের এক রাজনৈতিক প্রহসন লিখেছিলেন। তাঁর কলমের নেপথ্যে ছিল হিটলারের ক্রম উত্থান এবং বিশ্বজয়ের অলীক স্বপ্ন। তখনও রাজনীতিতে মাফিয়া, গুণ্ডা, বদমাইশ, চোর, লম্পটদের পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। যদিও লর্ড, ব্যারন, লেখক বা উচ্চশিক্ষিত মানুষরাই থাকতেন রাজনীতির প্রথম সারিতে। কিন্তু তাঁদেরও সমাজবিরোধীদের পোষার প্রয়োজন হত। কাজে কিংবা অকাজে এরাই ছিল হাতিয়ার। এত বছর পরও কোনও বদল তো ঘটেনি বরং দুর্বৃত্তের দল রাজনীতির সিংহাসন আঁকড়ে বসেছে। রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরেই সরে গিয়েছে শিক্ষিত সমাজ। বিষয়টি বিরক্তিকর হলেও সত্য।
ব্রেখটের পুরনো সেই নাটকটিকে আধার করে নতুন চেহারায় লিখেছেন অর্পিতা ঘোষ। শুধু লেখেননি, প্রযোজনা এবং নির্দেশনা করেছেন ‘ভিট্টন’ (Vitton) নাম দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমির সপ্তাহব্যাপী নাট্যোৎসব শুরুই হল গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসদন মঞ্চে এই ‘ভিট্টন’ নাটকটি দিয়ে। নাটকের প্রধান চরিত্র তরুণ ভবেশ নাথ গরীব এক ছাতাওয়ালার ছেলে হয়েও আধা ভরতপুর শহরের ত্রাস, ওখানকার ব্যবসায়ী সমিতির ‘পটেকশন’ দাতা। তার তোলাবাজ, গুণ্ডা, লম্পটের দল সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে কারখানার মালিক এবং রাজনৈতিক নেতা জগৎ সমাদ্দারের ‘কাছাকাছি’ আসে। অবশ্য তার পেছনেও ‘মতলব’ থাকে। এই ভবেশ নাথ ‘ভিট্টন’ হয়ে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সে রাজনীতির অঙ্গনে এসে বুঝতে পারে ‘মানি’, ‘মাসল পাওয়ার’ আর ‘পলিটিক্যাল পাওয়ার’ না থাকলে সমাজে ‘নেতা’ হওয়া যায় না।
[আরও পড়ুন: বাংলাদেশের মতো ভাষাদিবসে বইমেলা কলকাতায়, ‘একুশে বই উৎসবে’র ঠিকানা জানেন?]
সুতরাং ভিট্টন জগৎ সমাদ্দারের প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন নেতা হয়ে ওঠার পরিকল্পনা করে। তার দুই সাগরেদ আপাদমস্তক মস্তান রবি এবং কিঞ্চিৎ শিক্ষিত কৌশিক ঢুকে পড়ে অন্তর্দলীয় ঝামেলায়। আর নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে এবং বজায় রাখতে একে একে জগৎ সমাদ্দার, কারখানার নতুন মালিক সান্যাল, তাঁর তরুণ ছেলে, সংবাদপত্রের মালিক সম্পাদক সেনগুপ্তকেও খুন করে। আদতে ভরতপুর ও পার্শ্ববতী শহর রতনপুর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে ভিট্টনের খুনখারাপি, অসামাজিক কর্মকাণ্ডের চারণক্ষেত্র। সে হয়ে উঠতে চায় ‘নেতা’। কিন্তু শেষপর্যন্ত কী হয়? নাহ, সেটা বলার দরকার দেখি না। সেটা এখনকার শুধু আসন্ন বাংলা নয়, সারা ভারতের ভোটের পূর্ববর্তী অবস্থা দেখলেই মালুম হয়ে যায়। অর্পিতা ঘোষ (Arpita Ghosh) অত্যন্ত চাতুরি ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের “কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ? এ জগৎ মহা হত্যাশালা” সংলাপটি ব্যবহার করেছে নাটকের দু’টি তুঙ্গ মুহূর্তে। নির্বাচনের ক’মাস আগে থেকেই যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলোর তথাকথিত নেতারা যে ভাবে অশালীন বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ, সেটাই তো স্পষ্ট করে দিচ্ছে এখনকার রাজনীতিতে দুর্বৃত্তের জয়, সত্য বা শিক্ষার কোনও জায়গা নেই। এমন বাস্তব পরিবেশে দাঁড়িয়ে অর্পিতা ঘোষ যেন সত্যিই আমাদের সামনে একটি দীর্ঘ ও স্বচ্ছ আয়না এনে দিলেন। সাধারণ নাগরিক ভোট দেন অনেকটাই ভয়ে। ভক্তি থাকলেও, তার পেছনে কাজ করে ভয়। এটাও সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ভিট্টনের কথায়, “তুমি আমার সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ না করলে অশান্তি তো হবেই”- আর এটাই হল তাঁর পেশা ও জীবনের মূল মন্ত্র। কিন্তু একটা না একটা সময় ওই মূল মন্ত্র যে ফুসমন্তর হয়ে যাবে সেটা বোঝে ক’জন!
অত্যন্ত সময়োপযোগী অর্পিতার এই প্রযোজনা। গোটা মঞ্চ জুড়ে নাটকের কাণ্ডকে বিস্তীর্ণ করেছেন এবং দলের শিল্পী অভিনেতারা প্রায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পুরো সোয়া দু’ঘন্টা। এতটুকু শ্লথ হয়নি গতি। গানে, বাজনায়, নাচে, লম্পটদের লাম্পট্য মিলে মঞ্চ ছিল ভরপুর। নাম চরিত্রে অর্ণ মুখোপাধ্যায় একাই যেন একশো দশ। তাঁর চলন বলন, শরীরী ভাষা, আঙুলের ইশারায়, মস্তানি ভাবখানা এতটাই জীবন্ত যে দর্শকের সত্যিই রাগ হতে পারে। রবির চরিত্রের শিল্পীও অর্ণর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন। মঞ্চ পরিকল্পনা, আবহ, আলোর ব্যবহার – সবকিছুই নাটকের বহিরাঙ্গকে যেমন দর্শনীয় করেছে, তেমনি নাটকের অন্তরের কথাকেও স্পষ্ট এবং জোরদার করেছে। সব চাইতে বড় কথা হল এমন একটি নাটক এই সময়ে দাঁড়িয়ে উপস্থাপন করা। সাবাস অর্পিতা, চলতি রাজনীতির মধ্যে থেকেও এমন একটি নাটক উপহার দেওয়ার জন্য। অর্পিতা নিজে একবারই মঞ্চে এসেছেন – এক অভিনেত্রী হয়ে। যিনি আকাট মস্তান অর্ণকে চলন-বলন, আচারে সভ্য ও ভদ্র করে তুলবেন। ওই স্বল্প উপস্থিতিতেই তাঁর কবজির জোরটাও বোঝা গেল।