‘মিড’ মানেই মাঝারি, তাই মিড ক্যাপ ফান্ডে লগ্নি করলে লাভও মধ্যমানেরই হবে, এই ভাবনা থেকে সরে আসুন। এই ধরনের ফান্ড সবসময় চেষ্টা করে আরও, আরও ভাল রিটার্ন পাওয়ার। এর ভাল পারফরম্যান্স দীর্ঘমেয়াদি স্তরেও বহাল রয়েছে। মিড ক্যাপ ফান্ড নিয়ে যাবতীয় কৌতূহলের নিরসন এই লেখায় করলেন শৈবাল বিশ্বাস
শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক মিড ক্যাপ ইকুইটি ফান্ড কী? আমরা কীভাবে মিড ক্যাপ ফান্ড বর্ণনা করব? সেবি-র সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে যে সমস্ত স্টক ‘লিস্টেড’ তথা তালিকাভুক্ত হয়, তাদের প্রথমে নিজস্ব মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনে ১ থেকে ১০০ পজিশনে থাকা স্টকগুলি হল লার্জ ক্যাপ স্টক। সাধারণত এদের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন থাকে ৩০,০০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। ১০১ থেকে ২৫০ পর্যন্ত পজিশনের স্টকগুলি হল মিড ক্যাপ স্টক। এদের ক্যাপিটালাইজেশন থাকে ১০,০০০ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ৩০,০০০ কোটি টাকার মধ্যে। এর নিচে যা থাকে, তা স্মল ক্যাপ স্টক।
মিড ক্যাপ ফান্ডের বৈশিষ্ট্য–
খুব সহজে বুঝিয়ে বলতে গেলে, মিড ক্যাপ স্টক বলতে ঠিক যা বোঝেন, মিড ক্যাপ ফান্ডকে তারই ফলশ্রুতি বলা যায়। মিড ক্যাপ মিউচুয়াল ফান্ড আসলে ইকু্যইটি মিউচুয়াল ফান্ড, যা আপনার টাকা মিডক্যাপ সংস্থাগুলিতে বিনিয়োগ করে। নিজেদের পোর্টফোলিওর অন্তত ৬৫ থেকে ৯৫ শতাংশের মতো এরা এখানে লগ্নি করে। যদিও সেবির নয়া নিয়ম অনুযায়ী, মিড ক্যাপ স্টকসে অন্তত ৭৫ শতাংশ লগ্নি করা উচিত মিড ক্যাপ সংস্থাগুলির। এই ধরনের ফান্ড সাধারণত বিএসই মিড ক্যাপ ইনডেক্সের দিকে নজর রেখে এগোয় এবং সবসময় চেষ্টা করে আরও ভাল ‘রিটার্ন’ পাওয়ার।
মিড ক্যাপ ফান্ড কেন লার্জ ক্যাপ ফান্ডের থেকে ভাল ফল করেছে?
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ বড় ব্যবধানে লার্জ ক্যাপ স্টককে টপকে এগিয়ে গিয়েছে মিড ক্যাপ স্টক এবং এই পারফরম্যান্স বহাল রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি স্তরেও। এমনকী, বাজার ‘ডাউন’ থাকলেও এই স্টক, লার্জ ক্যাপ স্টকের মতো অতটা খারাপ ফলাফল করে না, যেমনটা অতীতে দেখা যেত। মিড ক্যাপ ফান্ডের কিছু নির্দিষ্ট সুবিধা রয়েছে। আর অবশ্যই আমাদের বিশ্লেষণ সুপরিচালিত মিড ক্যাপ স্টক নিয়েই।
l গত বছর তেলের দাম এবারের তুলনায় কম ছিল। এর ফলে তাদের মূল্য, পরিকাঠামো এবং অপারেটিং মার্জিনের বিন্যাসে সুবিধা হয়েছে। এখন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার জেরে এই মার্জিন কমে যেতে পারে এবং অস্থায়ী কিছু সংশোধনেরও প্রয়োজন পড়তে পারে।
l দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ, টেলিকম, পরিকাঠামো এবং ধাতব সম্পদের মতো সেক্টরে লার্জ ক্যাপ কোম্পানিগুলির মতো মিড ক্যাপ কোম্পানিগুলির উপর চড়া ‘লেভারেজ’ বসে না। তাই আর্থিক ঝুঁকি কম।
l তৃতীয়ত, মিড ক্যাপগুলি এমন সেক্টরে মনোনিবেশ করে, যেখানে তাদের মূল শক্তি তথা যোগ্যতা প্রদর্শন করা যায়। এতে ব্যবসা আরও সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করা যায়।
মিড ক্যাপ ফান্ড নির্বাচনের কোনও চেক লিস্ট আছে কি?
আছে। বেশ কিছু মাপকাঠি রয়েছে। যেমন–
l বিগত ৪-৫ বছরে ওই ফান্ড কেমন পারফরম্যান্স করেছে, আগে তা দেখুন। হ্যাঁ, আগে ভাল করলে ভবিষ্যতেও সমান ভাল করবে, সেই নিশ্চয়তা নেই কিন্তু কাছাকাছি যাওয়া হয়তো অসম্ভব হবে না। যদি ৪-৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে স্থিতিশীল পারফরম্যান্স দেয়, তাহলে ফান্ড ম্যানেজার যে ভাল স্টক বেছেছেন, তা নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়াই যায়।
l যখন আপনি কোনও মিড ক্যাপ ফান্ডে বিনিয়োগ করেন, তখন আপনার লক্ষ্য থাকে চোখে পড়ার মতো পারফরম্যান্স যেন মেলে। সুতরাং যেটা জরুরি, সেটা হল এই ধরনের ফান্ড কোথায় কী কী আছে, সেই জ্ঞান যেন আপনার থাকে। আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, ভাল স্টক যেইমাত্র বাছাই করা হয়ে গেল, তারপর এমন মিড ক্যাপ ফান্ড থেকে বিরত থাকুন এবং তা-ও আবার নিজের সামগ্রিক ইকু্যইটি মিউচুয়াল ফান্ডস পোর্টফোলিওর অন্তত ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত।
l মিড ক্যাপ ফান্ডের ক্রিসিল লিকুইডিটি স্কোর দেখে নিন। খুবই দরকারি বিষয়। মিড ক্যাপ ফান্ডের লিকুইডিটি রেশিও কত? এটি নির্ভর করে, মূল্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে ঠিক কতদিনে ফান্ড ম্যানেজার পোর্টফোলিও গুছিয়ে নিতে পারে। লার্জ ক্যাপ ফান্ডের লিকুইডিটি রেশিও ১.১ থেকে ১.৩ দিন, সেখানেই মিড ক্যাপের হল ৯-১১ দিন। এর থেকে লিকুইডিটি রিস্কের আভাস মেলে।
l ফান্ড ম্যানেজমেন্ট টিমের স্থিতাবস্থা এবং বিনিয়োগের কৌশলও মিড ক্যাপ ফান্ডের অত্যন্ত জরুরি অঙ্গ। কারণ গোটা বিষয়টিই হল বিনিয়োগের ‘বটম আপ’ কৌশলের অংশ। এমন ফান্ডে সফলভাবে লগ্নির অভিজ্ঞতা অর্জন হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। তাই ফান্ড ম্যানেজমেন্ট টিমের ধারাবাহিকতা খুব দরকারি।
l মূল বিষয় হল ঝুঁকি মেপে রিটার্ন। ঝুঁকি যোগ করে রিটার্ন বাড়ানো যেতেই পারে কিন্তু তাতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ঝুঁকি মেনে পদক্ষেপ নেওয়া যেমন ‘Sharpe Ratio’ এবং ‘Treynor Ratio’ জরুরি। আপনি কখনওই চাইবেন না, আপনার ফান্ড ম্যানেজার ঝঁুকির বহর বাড়িয়ে বেশি রিটার্ন দেওয়ার আশ্বাস ক্রমাগত দিয়ে যান।
l মিড ক্যাপ ফান্ডের পারফরম্যান্সের নিম্নমুখিতার উপর বেশি গুরুত্ব দিন, ঊর্ধ্বমুখিতার তুলনায়। এতে এই ধরনের ফান্ডের চরিত্র বোঝা সহজ হবে। বাজার ‘ডাউন’ থাকলে ঝুঁকি সামলাতে একজন ফান্ড ম্যানেজার কতটা দড়, তার স্পষ্ট ছবি পাবেন। এই অধোমুখিতাই আপনাকে লোভনীয় স্টকের তালিকা থেকে সেরাটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেবে।
l মিড ক্যাপের ক্ষেত্রে উপস্থিতি (availability) একটি বড় ঝুঁকি। আজও। আমরা অতীতে দেখেছি, এই ধরনের বহু ফান্ডের নতুন করে বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে কারণ নজরকাড়া দামে মিড ক্যাপ স্টকে লগ্নির সীমিত সুযোগ। এটাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আর সমস্যার তৈরি করতে পারে।
এর থেকে আমরা কী সিদ্ধান্তে এলাম? মিড ক্যাপ ফান্ড প্রত্যেকেরই পোর্টফোলিওতে থাকা উচিত। কারণ এতে আপনার পোর্টফোলিও সমৃদ্ধ হবে। তবে এমন স্টক কেনার আগে এই নিয়ে মনে যেন স্পষ্ট ছবি থাকে। কোনও বিভ্রান্তি না থাকে।
সত্যিই কি মিড ক্যাপ ফান্ডের জন্য মিড ক্যাপ স্টকের ‘চয়েস’ সীমিত?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ভারতে যত মিড ক্যাপ ফান্ড রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এটাই হল সবচেয়ে বড় ঝুঁকির জায়গা। বাজারে মিড ক্যাপ নিয়ে ধারণা সত্যিই সীমিত, ফলে ফান্ড ম্যানেজাররা এই নিয়ে বেশিদূর এগোতে পারেন না। সাধারণভাবে দু’টি বিকল্প থাকে। হয় তাঁরা লার্জ ক্যাপ স্টকে লগ্নি করেন বা গুণমান নিয়ে আপোসের পথ বেছে নেন। অর্থাৎ তেমন নামডাক নেই, চরিত্র নিয়ে সেই অর্থে নিশ্চয়তা নেই-এমন সংস্থার স্টক চয়ন করেন। মিড ক্যাপ ফান্ডে এই ছবিটা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়।
তবে ভারতের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে মিড ক্যাপ ফান্ডের বিকাশের বড় জায়গা রয়েছে কারণ এগুলি এই দেশে উদ্যোগপতি প্রতিভার স্পৃহা তথা উদ্দীপনাকে তুলে ধরে। যদিও মিড ক্যাপ ফান্ডের বিনিয়োগকারী হিসাবে আপনাকে বরাদ্দজনিত ঝুঁকি নিয়েও সর্বদা সচেতন থাকতে হবে।
(লেখক লগ্নি উপদেষ্টা)