সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: কুঁড়ে ঘরের দেওয়াল জুড়ে লোকনৃত্যের শিল্পকলা। ফুটে উঠছে নানান বন্যপ্রাণের ছবি। সেই সঙ্গে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া বিভিন্ন কারুকাজ, আঁকিবুকি। এক কথায় গ্রামাঞ্চলের সমাজজীবনের ছবি। জঙ্গলমহলের অন্যতম বড় পরব বাঁদনা বা সহরায়-কে ঘিরে এভাবেই সেজে ওঠে পুরুলিয়ার গাঁ-গঞ্জের ঘর দুয়ার, দেওয়ালের পর দেওয়াল। যেন মনে হয় ক্যানভাসে আঁকা ছবি। সেই দেওয়াল চিত্র এখন পর্যটনের অঙ্গ। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটচিত্র সরকারিভাবে পর্যটনে জুড়লেও বনমহল পুরুলিয়ার দেওয়াল চিত্র তার নিজস্ব গুনেই পর্যটনের শরিক হয়ে গিয়েছে।
কিভাবে? ঝাড়খন্ড ছুঁয়ে থাকা জঙ্গলমহলের এই জেলার পর্যটনের মরশুম পুজোর সময় থেকেই। এই ভরপুর মরশুম চলে একেবারে দোল পূর্ণিমা পর্যন্ত। যদিও এই জেলার পর্যটন এখন বর্ষা সহ সারা বছর-ই। তবে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় পুজো থেকে দোল পর্যন্তই। আর এই সময়ই অর্থাৎ কালীপুজোর রাত থেকে জঙ্গলমহলে শুরু হয় বাঁদনা পরব। যাকে ঘিরে বনমহলে এক আবেগ। এই উৎসব কোথাও তিন দিন, আবার কোথাও পাঁচ দিন। সাধারণভাবে ভাইফোঁটার মধ্যেই এই উৎসবের শেষ। কুড়মি জনজাতি ছাড়াও জঙ্গলমহলের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজনেরও এই প্রাণের পরব বাঁদনা। আর আদিবাসী জনজাতিদের সহরায় অনেকটা বাঁদনার মতই। তবে তাদের এই পরব চলে একেবারে মকর সংক্রান্তির আগে পর্যন্ত। কোন আদিবাসী গ্রামে কবে সহরায় হবে তা ঠিক করেন সেই গ্রামের বরিষ্ঠ মানুষজন। আর এই বাঁদনা ও সহরায়কে ঘিরেই ফুটে উঠে দেওয়াল চিত্র।
পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের গ্রামের পর গ্রাম এখন ক্যানভাস হয়ে উঠেছে। যেখানে রঙ, তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা যায় নিজের ইচ্ছে কথা, ভাবনা, কল্পনা। আর এই সময় ভরপুর পর্যটনে পর্যটকরা পা রাখেন বনমহলের এই গ্রামগুলিতে। সেই সঙ্গে ভিড় জমান আলোকচিত্রীরাও। ফি বছরই গ্রামীণ সংস্কৃতির নতুন কারুকাজ, নতুন শিল্পকলায় সেজে ওঠে গ্রামের দেওয়াল। একেবারে পরিবেশবান্ধব রঙে। দেওয়াল জুড়ে হস্তশিল্প এমনই চোখ টানা যে বিভিন্ন শর্ট ফিল্ম বা তথ্যচিত্র তৈরিতে অন্যতম লোকেশন হয়ে যায় জঙ্গলমহলের গ্রামের এই দেওয়াল ছবি। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্থির চিত্র শিল্পী তথা দেওয়াল চিত্র নিয়ে এখনও পর্যন্ত একমাত্র ফটো অ্যালবাম 'পেইন্টিংস অফ পুরুলিয়া'-র বইটির প্রণেতা স্বরূপ দত্ত বলেন, "আজ থেকে বছর ৪০ আগে যখন আমি ছবি তোলার কাজ শুরু করি তখন লক্ষ্য করেছিলাম সেরা স্থির চিত্রশিল্পীদের সংগ্রহে দেওয়াল চিত্র রয়েছে। এই দেওয়াল চিত্র এতটাই চোখ টানে যে আমিও সেই কাজ করি। এই শিল্প ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই আমি এই বিষয়কে নিয়ে একটি ফটো অ্যালবাম তৈরি করি। কিন্তু আজ দেখছি এই শিল্প তো ফুরিয়ে যায়নি। বরং ব্যাপক হারে প্রসার লাভ করেছে। যা পুরুলিয়ার গর্ব। কারণ পুরুলিয়ার দেওয়াল চিত্রের মধ্যে একটি নিজস্বতা রয়েছে। সেই স্বকীয়তাতেই সে উজ্জ্বল হয়ে সর্বত্র সাড়া ফেলেছে। কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এক বেদনা। এই দেওয়াল চিত্র চোখে দেখতে নাগরিক সভ্যতা যে ভাবে হামলে পড়েছে। এবং শহরের মানুষজন সেই দেওয়ালে আঁকা শুরু করেছেন। তখনই হারিয়ে যাচ্ছে এর নিজস্বতা।"
আসলে এখানকার মূলবাসীদের বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব রঙে, একেবারে মাটির ঘ্রাণে যে শিল্পকলা ফুটে ওঠে তা অনেকটাই মার খাচ্ছে বলে মনে করেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত স্থির চিত্রশিল্পী। 'পেন্টিংস অফ পুরুলিয়া'-র বইটিতে সূচনা লিখেছিলেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। ফলত সিনেমা জগতেও পুরুলিয়ার দেওয়াল চিত্র একটা আলাদা জায়গা করেছে। আর বর্তমানে ইউটিউবাররাও আরও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দিচ্ছে এই বনমহলের শিল্পকলাকে। যারা কুঁড়ে ঘরের দেওয়ালে, আঁকিবুকিতে এক শিল্পের রূপ দেন। তারা কিন্তু কেউ নামকরা শিল্পী নন। কেউ ঘরের বধূ, কেউ মেয়ে বা তরুণী বা গৃহস্থের কর্তা। তাদের শিল্পী মন, নিপুণ হাত আর পরিবেশবান্ধব কাঁচা রঙে বনমহলের দেওয়ালের পর দেওয়াল আক্ষরিক অর্থেই ক্যানভাস।
পুরুলিয়া হোটেল ও লজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহিত লাটা বলেন, " দেওয়াল চিত্র তুলে ধরা গ্রামগুলি এখন পুরুলিয়ার পর্যটনের অন্যতম সাইট সিয়িং হয়ে গিয়েছে। সমাজ মাধ্যমে বিভিন্ন খোঁজ-খবর নিয়ে পর্যটকরা আমাদেরকেই বলছেন আমরা এই গ্রামে যাব, ওই গ্রামে যাবো। ফলত আমাদেরকেই এই দেওয়াল চিত্র বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে সবকিছু আপডেট থাকতে হচ্ছে। একেবারে আপনাআপনি এই হস্তশিল্প কলা পর্যটনের অঙ্গ হয়ে যাওয়ায় প্রশাসন তথা রাজ্য পর্যটন বিভাগের কাছে দাবি জানাবো দেওয়াল চিত্রকে পর্যটনে জুড়ে দিয়ে একটা আলাদা পরিকাঠামো গড়ে তুলুক। বা এটাকে সরকারিভাবে তুলে ধরা হোক। যাতে এই বিপুল সম্ভাবনাকে পর্যটনে আরও কাজে লাগানো যায়। "
পুরুলিয়ার অযোধ্যা হিল টপের কচুরিরাখার একটি চারতারা হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার সুদীপ্ত কুমার বলেন, "এই জঙ্গলমহলের জেলায় কোন গ্রামে কি ধরনের দেওয়াল চিত্র হয় তার জন্য তো আমরা একটা আলাদা তথ্যপঞ্জি তৈরি করতে বাধ্য হয়েছি পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে। আমরা যে সাইট সিয়িং করায় সেখানে দেওয়াল চিত্রের গ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। " তবে শুধু পুরুলিয়া নয়। ঝাড়গ্রাম, দক্ষিণ বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরের একাংশেও এই দেওয়াল চিত্র দেখা যায়। তবে পুরুলিয়ার একটা আলাদা ঘরানা রয়েছে তা মানছেন লোকসংস্কৃতি গবেষকরা। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর দুই ব্লকের চেলিয়ামার বাসিন্দা, লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় বলেন, "শুধু বাঁদনা বা সহরায়-এ নয়। পুরুলিয়ার বেশ কয়েকটি গ্রাম আছে যেখানে সারা বছরই এই দেওয়াল চিত্র চোখে পড়ে। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলেও তা আবার নতুন করে তৈরি করা হয়। স্বচ্ছতার লক্ষ্যেই এই প্রয়াস। এর বড় উদাহরণ হুড়ার হাতিমারা। দেওয়াল চিত্রের এমন কিছু গ্রাম বান্দোয়ানেও আছে।"
বিহারের মধুবনী চিত্রকলা এই শিল্পকলাতে বিখ্যাত। যাকে 'মিথিলা পেইন্টিং' বলে। রয়েছে রাজস্থানী চিত্রকলাও। যা 'রাজপুত চিত্রকলা' নামেও পরিচিত। এছাড়া যামিনী রায়ের শিল্পশৈলী শুধু বাংলায় নয় সমগ্র দেশেই একটা আলাদা কদর। পুরুলিয়ার এই দেওয়াল চিত্র যেখানে গ্রামীণ সংস্কৃতি আর সমাজজীবনের কথা ফুটিয়ে তুলেই দেশের বিখ্যাত সব দেওয়াল শিল্পের মধ্যেই আলাদা ঘরানা হয়ে উঠেছে।
