সুমিত বিশ্বাস, কোটশিলা (পুরুলিয়া): এলাকা বদল করে ‘হোম রেঞ্জ’ বাড়াচ্ছে পুরুলিয়ার (Purulia) কোটশিলা বনাঞ্চলে থাকা চিতাবাঘ। সিমনি বিট থেকে ওই চিতা ঢুকে পড়েছে লাগোয়া নোয়াহাতু বিটের তাহেরবেড়া গ্রামে। ফলে ভয়ে কাঁটা ঝাড়খণ্ড ছুঁয়ে থাকা নোয়াহাতু বিটের পাহাড়তলি গ্রামগুলি। সন্ধেবেলাই রাত নামছে ওই এলাকায়। সন্ধ্যার পরে শৌচকর্মের জন্য ঘর থেকে বেরলেই হাতে থাকছে টর্চ, ধারালো অস্ত্র। তাহলে কি চিতাবাঘ-মানুষের অসম লড়াইয়ের ইঙ্গিত?
প্রায় এক দশক আগে পুরুলিয়া বনবিভাগের কোটশিলা বনাঞ্চলের এই নোয়াহাতু বিটের টাটুয়াড়ায় একটি পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘকে (Leopard) পিটিয়ে মেরেছিলেন এলাকার মানুষজন। ফলে শাস্তির মুখে পড়েছিলেন বনকর্তা। এবারও প্রায় একই ঘটনা। নতুন চিতাবাঘের আতঙ্ক নিয়ে উদাসীনতার অভিযোগে মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই সরতে হলো পুরুলিয়া বনবিভাগের ডিএফও কার্তিকায়েন এমকে। নতুন ডিএফও হিসাবে হিসেবে পুরুলিয়া বনবিভাগে যোগ দেবেন বাঁকুড়ার পাঞ্চেত বনবিভাগের ডিএফও অঞ্জন গুহ।
সরস্বতী পুজোর (Saraswati Puja) আগের রাতে ১৩ ফেব্রুয়ারি তাহেরবেড়া গ্রামে হানা দেয় ওই চিতা। ওই দিন বৃষ্টি ভেজা থাকায় পরের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি স্পষ্টভাবে অসংখ্য পায়ের ছাপ দেখা যায় তাহেরবেড়া থেকে খিড়কি পাহাড় যাওয়ার পথে। এখনও অর্থাৎ রবিবার দুপুরেও তাহেরবেড়া গ্রামের পূর্বদিকে পুকুর পাড়ের মেঠো পথে ওই পাহাড়ে যাওয়ার পথে অসংখ্য পায়ের ছাপ রয়েছে। যা দেখে বোঝা যাচ্ছে, একটি পূর্ণবয়স্ক সেইসঙ্গে সাব অ্যাডাল্ট চিতা। অথচ এই বিষয়টি জানেই না বনদপ্তর। নোয়াহাতু বিট অফিসার শঙ্কর গড়াই বলেন, “চিতাবাঘের বিষয়ে আমাদের মাইকিং চলছে। প্রচারপত্রও বিলি হচ্ছে। তবে তাহেরবেড়ায় ওই পায়ের ছাপের বিষয়ে কিছু শুনিনি। আসলে এলাকায় আতঙ্ক ভীষণভাবে চেপে বসেছে।”
[আরও পড়ুন: ‘কাঞ্চন আমাকে ভালো সামলাবে’, ৫৩-র তারকা বিধায়ককে বিয়ে করেই ট্রোলের জবাব শ্রীময়ীর]
রবিবার দুপুরে গ্রামে পা রাখলে সেখানকার মানুষজনই গ্রামের পূর্বদিকে নিয়ে গিয়ে পুকুর পাড়ে খিড়কি পাহাড়ে যাওয়ার পথে চিতাবাঘের অসংখ্য পায়ের ছাপ দেখান। তাদের চোখেমুখে রীতিমত আতঙ্ক। সন্ধের পর ঘরবন্দি ছাড়া যে আর কোনও উপায় নেই এমন কথা বলছেন তাঁরা। সবচেয়ে সমস্যা, এই এলাকায় ঘরে ঘরে শৌচালয় না থাকায় শৌচকর্ম করতে রাতের বেলায় ঘর থেকে বাইরে পা রাখতে হয়। তাই চিতাবাঘের আতঙ্কে পুরুষ মহিলারা হাতে বড় টর্চের সঙ্গে কুঠার, দা-র মতো ধারালো অস্ত্র রাখছেন। তাহেরবেড়া গ্রামের বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন কুমার, ফলারি মাঝিদের কথায়, “গ্রামের কাছ দিয়ে চিতাবাঘ চলে যাচ্ছে, কী বলব? ভীষণই ভয়ে রয়েছি আমরা। নিম্নচাপের বৃষ্টি শেষে রোদ বার হওয়ার পরেও পায়ের ছাপ স্পষ্ট। কি করবো বুঝতে পারছি না। বনদফতর সেই জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে একবার মাইকিং করে চলে গিয়েছে। তারপর আর এই মুখো হয়নি।”
ওই গ্রামের পঞ্চমী মাহাতো বলেন, “আমাদের গ্রামে ঘরে-ঘরে শৌচালয় নেই। ফলে বাধ্য হয়েই রাত-বিরেতে ঘর থেকে বার হতে হয়। তাই আমরা রাতে ঘরের বাইরে পা রাখলে হাতে ধারালো অস্ত্র রাখছি।” এলাকার বাসিন্দা মধুসূদন সোরেন বলেন, “একটা নয়, জোড়া চিতাবাঘ ঘুরছে গ্রামে। একটা পূর্ণবয়স্ক, আরেকটা ছোট। একেবারে সামনাসামনি পায়ের ছাপ থেকে স্পষ্ট। খুব ভয়ে ভয়ে দিন কাটছে আমাদের।” গত জানুয়ারির শেষের দিকে সিমনি বিটের সিমনি গ্রামে চিতাবাঘ ঘরে ঢুকে গবাদি পশুকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারপর থেকেই ভয়ে কাঁটা এই বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষজন।
[আরও পড়ুন: নাভালনির শোকসভা পালন বেআইনি! শতাধিক অনুগামীকে জেলে পাঠাল রাশিয়া]
এই ধরনের বন্যপ্রাণের ‘টেরিটোরিয়াল’ ও ‘হোম রেঞ্জ’ থাকে। ‘টেরিটোরিয়াল রেঞ্জ’ বলতে যে এলাকায় তার বসবাস সেখানে তার সমতুল কোনও বন্যপ্রাণকে আসতে দেয় না। ‘হোম রেঞ্জ’ এলাকায় সে শিকার করে। ফলে ওই চিতাবাঘ সিমনি বিট থেকে লাগোয়া নোয়াহাতু বিটে এসে শিকারের পরিধিস্থল বাড়াচ্ছে না তো? শুধু তাই নয়, পরিধিস্থল বাড়াতে গিয়ে পূর্ণবয়স্ক মাদি চিতা সাব অ্যাডাল্টকে কি শিকারে অভ্যাস করাচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো উঠেই যাচ্ছে। বনদপ্তর জানাচ্ছে, দুবছর হলে চিতা বাঘকে পূর্ণবয়স্ক বলা যায়। রেসিডেন্সিয়ালের তকমা পাওয়া সাব অ্যাডাল্ট ওই চিতার জন্ম হয় কোটশিলা বনাঞ্চলেই ২০২২ সালের বর্ষায় জুন-জুলাই মাস নাগাদ। ওই সাব অ্যাডাল্ট চিতা এখন তার মায়ের সঙ্গে ঘুরছে, এই বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না বনদপ্তর।
দেখুন ভিডিও: