শুভময় মণ্ডল: উৎসব মানে তো আনন্দের উদযাপন। নিজের আনন্দানুভূতি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াতেই উৎসবের সার্থকতা। তাই তো বলা হয়, ‘ধর্ম যার যার/ উৎসব সবার।’ উৎসব সম্প্রীতির বাঁধন। এবারের শারদীয়ায় সেই বাঁধন আরও দৃঢ় করছেন বাগুইআটির বাসিন্দা তমাল দত্ত। নিজগৃহে দেবী দুর্গার আরাধনার অঙ্গ হিসেবে এবছর তাঁর হাতে পূজিতা হবেন এক মুসলিম কন্যা, কুমারী রূপে। সুদূর উত্তরপ্রদেশের ফতেপুর সিক্রি থেকে সেই বালিকা বাংলায় এসেছে পূজা গ্রহণ করতে। আজকের দিনে, যখন সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, তখন তমালবাবুর এই উদ্যোগই সম্প্রীতির প্রদীপ সদা জ্বালিয়ে রেখেছেন।
[আরও পড়ুন: পুজোর প্রেম মানে শারদীয়া সাহিত্য, বললেন ব্রাত্য বসু]
পেশায় বাগুইআটির বাসিন্দা তমাল দত্ত একজন ইঞ্জিনিয়ার। কামারহাটি পুরসভায় চাকরি করেন। ২০১৩ সাল থেকে নিজের বাড়িতে দশভুজার আরাধনা করছেন। নিয়ম মেনে কুমারী পুজো করে থাকেন। ব্রাহ্মণ কন্যার পাশাপাশি অব্রাহ্মণ কুমারীদেরও পুজো করেছেন তমালবাবু। তাঁর ইচ্ছে ছিল, একবার দেবী দুর্গার সঙ্গে এক অ-হিন্দু কন্যার পূজার্চনা করবেন। কিন্তু সেই ইচ্ছে আর পূরণ হয়ে উঠছিল না। এমন কোনও উদারমনস্ক মুসলিম পরিবারের খোঁজ তিনি পাননি, যাঁরা নিজের কুমারী মেয়েকে হিন্দুরীতি মেনে একটি পুজোর জন্য পাঠাবেন। তাই মনে একটা অন্ধকার ছিলই।
তবে এবছর তমালবাবুর সেই সুপ্ত বাসনা পূরণ করতে এগিয়ে এলেন তাঁরই পরিচিত কামারহাটির বাসিন্দা মহম্মদ ইব্রাহিম। তিনি তমালবাবুর এই ইচ্ছের গুরুত্ব বুঝেই তাঁকে আশ্বাস দেন, ব্যবস্থা করবেন। তিনিই মুশকিল আসান করলেন। ইব্রাহিমের ভাগনি, ফতেপুর সিক্রির চার বছরের ছোট্ট মেয়ে ফতেমার হাত ধরেই তমালবাবুর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা এবছর মিটতে চলেছে। ২০১৯এ তাঁর বাগুইআটির বাড়িতে অষ্টমীতে পূজিতা হবেন ফতেমা। আনন্দ যেন আর ধরে রাখতে পারছেন না তমালবাবু। মহম্মদ ইব্রাহিমকে যে কীভাবে ধন্যবাদ জানাবেন, বুঝতেই পারছেন না। তমালবাবুর কথায়, ‘আমার জীবনের আদর্শ স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৮ সালে তিনিও এক মুসলিম কন্যাকে দেবীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। সেই ঘটনাই আমাকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। তাই আমি চেয়েছিলাম, এক মুসলিম কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করতে। এতদিন পর সেই ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছু হয় না।’
স্বামী বিবেকানন্দই যখন পূজকের আদর্শ, তখন এই মনীষীর জীবনে এই কাহিনি একবার মনে করলে মন্দ হয় না। সেটা ১৮৯৮ সাল। বিশ্ব পরিব্রাজকরূপে খ্যাতিলাভ করে ভারতে ফিরেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের নানা প্রান্তে।সপারিষদ কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে রয়েছেন ডাল লেকের একটি হাউসবোটে। সেখানকার মাঝি এক মুসলিম ব্যক্তি। তিনিই সন্ন্যাসীর আতিথেয়তার দায়িত্বে। তো সেই মাঝির এক ছোট্ট কন্যা মাঝেমধ্যেই গেরুয়া পরিহিত অতিথিদের খেলার সঙ্গী হয়ে উঠত। স্বামী বিবেকানন্দ নিজে মেয়েটিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। এমনই একদিনে কিছু পাহাড়ি ফুল হাতে পান বিবেকানন্দ। তারপর ছোট মেয়েটি তাঁর কাছে যেতেই তার পায়ে সেই ফুল অর্পণ করে, প্রণাম করেন বিশ্ববরেণ্য সন্ন্যাসী। তাঁর এই অর্পণ কোনও পঞ্জিকা, তিথি মেনে সে অর্থ কুমারী পূজা নয়। কিন্তু মুসলিম কন্যাকে দেবীরূপে পূজা – অষ্টাদশ শতকে সেই ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সময় এবং ঘটনাপ্রবাহে আজও সেই সময়ের মধ্যে দিয়েই আমরা চলেছে, যেখানে এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরেক সম্প্রদায়ের দূরত্ব বাড়ানোর একটা সূক্ষ্ম চক্রান্ত চলছে।
[আরও পড়ুন: সোপান বেয়ে শক্তির দরবারে, পুজোয় উত্তরণের পথ দেখাবে ৬৪ পল্লি]
তাই আজকের দিনে তমাল দত্ত আর ফতেমা যেন স্বামী বিবেকানন্দ আর মুসলিম মাঝির ছোট কন্যার প্রতিভূ। মেয়ে দুর্গার অংশ কুমারী হিসেবে পূজিতা হবে, এই প্রস্তাব পেয়ে তাই আনন্দ ধরে রাখতে পারেননি ফতেপুর সিক্রির সামান্য মুদি দোকান চালানো মহম্মদ তাহির এবং তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবি। প্রস্তাবে সাগ্রহে সাড়া দিয়ে এখনই চলে এসেছেন কলকাতায়। তাঁরা বলছেন, আজকের দিনে যখন বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ বেশি করে সামনে আসছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এক হিন্দু পূজারির এই উদ্যোগ আশার আলো দেখায়। হয়ত সামান্য আয়োজনেই দুর্গাপুজো করবেন তমাল দত্ত। কিন্তু এত জৌলুসের মধ্যেও তাঁর পুজো অনন্য হয়ে থাকবে ফতেমার ছোঁয়ায়।
The post পুজোয় মুসলিম কন্যাকে কুমারী রূপে আরাধনা, সম্প্রীতির নজির বাগুইআটির দত্ত পরিবারের appeared first on Sangbad Pratidin.
