বিশ্বদীপ দে: বৃত্ত বোধহয় একদিন না একদিন সম্পূর্ণ হয়ই। ইতিহাস সব সময় মসৃণ পথে না চললেও কোনও না কোনও ভাবে সে একটা দিশা খুঁজেই নেয়। গত মাসের একেবারে শেষে টাটা গোষ্ঠী ফিরে পেয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার (Air India) মালিকানা। ১৮ হাজার কোটি টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব এই বিমান সংস্থাটি কিনে নিয়েছে তারা, যা একসময় তাদেরই ছিল। মাঝে কেটে গিয়েছে সাতটি দশক। সব মিলিয়ে ৯০ বছরের ইতিহাস। আর ইতিহাস মানেই তো গল্প। যার কিছু জানা। আর কিছুর গায়ে জমে থাকে বিস্মৃতির ধুলো। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সময়ে সেই ধুলো ঝেড়ে উলটে পালটে দেখে নেওয়া যাক হারিয়ে যাওয়া আশ্চর্য সব কাহিনি।
১৯৩২ সাল। প্রথমবার আকাশে ওড়ে টাটা এয়ারলাইন্সের বিমান। হ্যাঁ, তখন এই নামই ছিল। পরে যা বদলে যায় এয়ার ইন্ডিয়ায়। টাটার প্রথম বিমান উড়েছিল করাচি থেকে মুম্বইয়ের (তৎকালীন বম্বে) উদ্দেশে। মাঝে তা নেমেছিল আহমেদাবাদে। অবশ্য়ই যাত্রীবাহী বিমান নয়। সেটা ছিল এয়ার মেল। চিঠিপত্তর নিয়ে ওড়া সেই বিমানটি চালিয়েছিলেন দেশের প্রথম লাইসেন্সপ্রাপ্ত পাইলট জেআরডি টাটা! হ্যাঁ, সংস্থার প্রথম চেয়ারম্যান নিজেই চালিয়েছিলেন প্রথম বিমান! পরে স্মৃতিচারণায় টাটাজি জানিয়েছিলেন, কীভাবে ভিতরে ভিতরে উত্তেজনায় ফুটছিলেন তিনি। প্রার্থনা করছিলেন, যেন সব নির্বিঘ্নে উতরে যায়।
[আরও পড়ুন: এ যে সাক্ষাৎ জটায়ু! লোকসভায় বিজেপি সাংসদকে দেখে চমকে উঠলেন অনেকেই]
প্রথম বছরখানেকের মধ্য়েই বিমান ওড়ে ২ লক্ষ ৬০ হাজার কিলোমিটার। সংস্থার লাভ হয় ৬০ হাজার টাকা। এরপর টাটা গোষ্ঠী (Tata) তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শুরু করে আন্তর্জাতিক উড়ান। শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেতে থাকা এয়ার ইন্ডিয়া (তখনও টাটা এয়ারলাইন্স) প্রথম ৫ বছরে ৬ লক্ষ টাকা উপার্জন করে। যা সেই সময়ের নিরিখে বিপুল অঙ্ক। আসলে দেশের ধনী সম্প্রদায় দেশের বিভিন্ন রাজ্য, এমনকী বিশ্বের নানা প্রান্তের শহরে অনেক দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার এই সুযোগকে লুফে নিয়েছিলেন বলা যায়।
কেমন ছিল শুরুর সেই দিনগুলো? জানা যায়, সেই সময় বিমানবন্দরের আশপাশে ভিড় জমে যেত বিমান ওড়া দেখতে। ঠিক যেমন রুপোলি পর্দায় ছবির নড়ে চড়ে বেড়ানো দেখলে তাক লেগে যেত, তেমনই ডাঙায় ছুটতে ছুটতে অতিকায় বিমানের আকাশে ভেসে যাওয়া দেখলেও একই রকম বিস্ময়ের ঘোর লেগে যেত সকলের।
[আরও পড়ুন: বক্তৃতা শুনে মাথাগরম হয়ে গিয়েছিল, বলছে ওয়েইসির গাড়িতে গুলি চালানোর ঘটনায় অভিযুক্তরা]
এয়ার ইন্ডিয়ার কথা বলতে বসলে অবধারিত ভাবেই বলতে হয় মহারাজার কথা। আজকের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিমান সংস্থার দাপাদাপির ভিড়ে ম্লান হয়ে যাওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার মতোই তার ম্যাসকটও যেন কিছুটা বিস্মৃত। অথচ প্রজন্মের পর প্রজন্ম মহারাজা ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। রঙিন রাজপোশাক, মাথায় পাগড়ি- রাজকীয় হয়েও আসলে অতিথিবৎসল ভারতের এক প্রতিনিধি এই ম্যাসকট। তাঁর সবচেয়ে বড় আইডেন্টিফিকেশন মার্ক জাঁদরেল গোঁফ। হেড আপিসের বড়বাবু তো বলেই ছিলেন, ‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।’ মহারাজার ক্ষেত্রে তা ষোলো আনা সত্য়িই। ১৯৪৬ সালে সংস্থার কমার্শিয়াল ডিরেক্টর ববি কুকা আরেক শিল্পী উমেশ রাওয়ের সঙ্গে মিলে তৈরি করেছিলেন মহারাজাকে। অবিভক্ত ভারতের (আজকের পাকিস্তানে) শক্তিশালী এক উদ্যোগপতি ছিলেন সইদ ওয়াজিদ আলি। তাঁর গোঁফজোড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিল মহারাজার অনুপ্রেরণা।
ম্যাসকটের জৌলুস আর এয়ার ইন্ডিয়ার জাঁকজমকপূর্ণ পরিষেবা যেন সমার্থক। যদিও ১৯৫৩ সালে স্বাধীন ভারতের সরকার অধিগ্রহণ করেছিল সংস্থাটি। কিন্তু চেয়ারম্য়ান রেখে দেওয়া হয়েছিল জেআরডি টাটাকে। তাঁর নেতৃত্বে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে ততদিনে বিশ্বের অন্যতম উড়ান সংস্থা হয়ে উঠেছে এয়ার ইন্ডিয়া। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানকে বলা হত ‘আকাশের গায়ে এক প্রাসাদ’। গত শতাব্দীর পাঁচ, ছয় ও সাতের দশক ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার সবচেয়ে সোনালি সময়। বলা হয়, সেই সময় তাদের বিমানে সফর করা মানেই রূপকথার মতো এক পরিবেশের ভিতরে বুঁদ হয়ে থাকা। আতিথেয়তা এমনই ছিল, মার্কিন কিংবা ইউরোপের লোকজনও চোখ বুঝে ভরসা করতেন এয়ার ইন্ডিয়াকে।
এমন সাফল্যের মাঝেও কিন্তু তৃপ্তির কোনও জায়গা ছিল না জেআরডি টাটার কাছে। শোনা যায়, তিনি যাত্রীদের সঙ্গে নিজে কথা বলতেন! আজকের দিনে কর্পোরেট গাম্ভীর্যের দিনে একথা কল্পনাও করা যায় না। সেদিনের যাত্রীরা জানিয়েছেন যেভাবে সুন্দরী বিমানসেবিকারা গ্লাসে ঢেলে দিতেন ওয়াইন, যেভাবে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা প্রত্যেক যাত্রীর খেয়াল রাখতেন, যে ধরনের আসবাবে পরিবেশিত হত খাবার- তা এয়ার ইন্ডিয়ার বনেদিয়ানাকেই প্রকাশ করে চলত।
কেবল বিমানই নয়, এয়ার ইন্ডিয়ার সেযুগের লাউঞ্জও ছিল চোঁখ ধাঁধানো। জয়পুরের হাওয়ামহলের ধাঁচে তৈরি হত ‘ঝরোখা জানলা’। ব্যবহার করা হত নানা ধরনের রাজকীয় মোটিফ! সর্বত্রই ছিল জৌলুস। কেবল সেযুগের বিমানসেবিকাদের নিয়েই আলাদা লেখা হতে পারে। ১৯৮৯ সালে মিস ওয়ার্ল্ড এয়ারলাইন্স হয়েছিলেন সুনীতা সোধি কাঙ্গা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ”এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানসেবিকা হওয়া মানে ছিল সম্মান ও সম্ভ্রমের এক অনন্য প্রাপ্তি। এয়ার ইন্ডিয়ার মেয়েদের কঠোর প্রশিক্ষণ নিতে হত। মেক আপ সেশন থেকে শাড়ি পরার সঠিক আদবকায়দা সবই শিখতে হত।”
কিন্তু ১৯৭৮ সালের এক দুর্ঘটনায় রাতারাতি যেন সব বদলে গেল। ২১৩ জন মারা যান সেই দুর্ঘটনায়। এর অভিঘাতেই পদত্যাগ করেন জিআরডি টাটা। বছর দুয়েক পরেই বোর্ড থেকেও সরে যান তিনি। এই ধাক্কার পর থেকেই ক্রমে লোকসান থেকে আরও বেশি লোকসানের দিকে চলে যেতে থাকে এয়ার ইন্ডিয়া। পরে সংস্থার দায়িত্ব নেন রতন টাটা। কিন্তু সংস্থা ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে। ২০১২ সালে ৬৩ হাজার কোটি টাকার দেনায় ডুবে যায় এয়ার ইন্ডিয়া। সেই থেকেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। অবশেষে নিলামে এয়ার ইন্ডিয়া ফের কিনে নিল টাটা গোষ্ঠীই। টাটার সঙ্গে জোর টক্কর ছিল স্পাইস জেটের প্রতিষ্ঠাতা অজয় সিংয়ের। রতন টাটা টুইটারে পোস্ট করে লেখেন, ”পুনরায় স্বাগত এয়ার ইন্ডিয়া।” পূর্ণ হল একটি বৃত্ত। রয়ে গেল ইতিহাস। যে ইতিহাস কেবল কোনও একটি বিমান সংস্থার মাত্র নয়- বলা যায় গত কয়েক দশকে ক্রমশ বদলে যেতে থাকা ভারতেরই ইতিহাসের এক অন্যতর রূপ।