সুচন্দ্রা মজুমদার, ওয়াশিংটন: আমেরিকায় এখন শীতের আগমনবার্তা৷ পরিবেশে কনকনানি বাতাসের সঙ্গে রুক্ষতার পরশ৷ কিন্তু আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের মনে বসন্তের ছোঁয়া৷ বিশেষত, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের সমর্থকদের৷
শেষ মুহূর্তের প্রচারে হিলারি ও তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প, দু’জনেই ছিলেন ওহাইয়োতে৷ ক্লিভল্যান্ডে হিলারির সভায় তাঁকে ঘিরে তরুণ প্রজন্ম, লাতিন আমেরিকান, এশীয় বংশোদ্ভূত ও অ্যাফ্রো-আমেরিকানদের যে উন্মাদনা দেখা গেল, অভাবনীয়৷ তাহলে কি হিলারিই শেষ হাসি হাসবেন? ব্যাপারটা অবশ্য ততটা সহজ নয়৷ ওয়েলমিংটনে ট্রাম্পের সভায় দলে দলে ছুটছেন ‘হোয়াইট আমেরিকান’রা৷ যদিও হিলারির সভার উচ্ছ্বলতার সঙ্গে ট্রাম্পের সভার কোনও মিল নেই৷ রিপাবলিকান প্রার্থী অনেক আগ্রাসী, সমর্থকরাও তেমনই কট্টর৷ ট্রাম্প বলছেন, “আমাদের লড়াই কঠিন৷ কিন্তু কোনও কিছুই আমাদের থামাতে পারবে না৷”
(সুইং-রিভার্স সুইংয়ে জমে উঠেছে আমেরিকার ভোট)
কিন্তু ট্রাম্পের পক্ষে বড় সমস্যা, রিপাবলিকান পার্টির কোনও জনপ্রিয় মুখই তাঁর হয়ে প্রচারে বিশেষ নামেননি৷ একাই ‘ট্রাম্প-শো’ চালাচ্ছেন রিপাবলিকান প্রার্থী৷ যেমন রিয়্যালিটি শো করতেন৷ এবার সঙ্গে পেয়েছেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে৷ একইভাবে ইন্দো-মার্কিন ভোটারদের সমর্থন পেতে মরিয়া রিপাবলিকান প্রার্থী৷ শনিবার তাঁর পুত্র এরিক হাজির হয়েছিলেন ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোয় একটি মন্দিরে৷ সেখানে আরতিতে অংশ নেন তাঁরা৷ স্যুট পরে এলেও দ্রুত তা পাল্টে শেরওয়ানি পরে নেন এরিক৷ পুরোহিতের কাছে রাম-কৃষ্ণের গল্প শোনেন৷ ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ ফ্লোরিডায় ধনী ভারতীয়দের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান৷ আসন্ন নির্বাচনে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন৷ তাই বারবার কখনও পুত্র, কখনও পুত্রবধূকে মন্দিরে পাঠিয়ে ভারতীয়দের মন জয় করার চেষ্টা করছেন ট্রাম্প৷ দেওয়ালির সময় তাঁর পুত্রবধূ লরা ভার্জিনিয়ার মন্দিরে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু তাতে কতটা কাজ হবে? বছর চারেক ধরে কলোরাডোয় গবেষণার সঙ্গে যুক্ত দীপঙ্কর ঘোষ জানালেন, একটা টানাপোড়েন অনেকের মধ্যেই কাজ করছে৷ কারণ, দুই প্রার্থীর সম্পর্কে প্রতিদিন এত নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে যে, চিরাচরিতভাবে রক্ষণশীল হিন্দু বা ভারতীয়রা চট করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না৷ এমনিতে ভারতীয়দের অধিকাংশই ডেমোক্র্যাট সমর্থক৷ কিন্তু এবার তাঁদের অনেকে মত পাল্টাতে পারেন৷ বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত সম্রাট সিনহা দীর্ঘদিন মুম্বইয়ে ছিলেন৷ মাস পাঁচেক হল লস অ্যাঞ্জেলেসে বদলি হয়ে এসেছেন৷ এখানকার রাজনীতি সম্পর্কে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই৷ কিন্তু তাঁর মত, অভিবাসী ও আউটসোর্সিং নিয়ে ট্রাম্পের কড়া অবস্থান ভারতীয়দের মধ্যে বিরূপ প্রভাব তৈরি করেছে৷ তার উপর এবার নেতিবাচক ভোটে জয়-পরাজয় চূড়ান্ত হবে৷ অর্থাত্ কাকে কত বেশি মানুষ অপছন্দ করেন, সেই ছবিটাই ফুটে উঠবে ভোটের বক্সে৷
এই অবস্থায় মূলত ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড’ স্টেটগুলিতে ছুটে বেড়াচ্ছেন ট্রাম্প-হিলারি৷ দোদুল্যমান ভোটারদের যাতে নিজেদের পক্ষে আনা যায়৷ সিএনএন তাদের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানিয়েছে, ট্রাম্পের চেয়ে গোটা দেশে পাঁচ শতাংশ ভোটে এগিয়ে হিলারি৷ কিন্তু কয়েকটি স্টেটে ভোটের সুইং যাবতীয় সমীক্ষা পাল্টে দিতে পারে৷ হিলারি তাই ভোটারদের টানতে পপ কনসার্টের ব্যবস্থা করেছেন৷ বেয়ন্সে, কেটি পেরিদের মতো তারকাকে মঞ্চে নামিয়েছেন৷ অন্যদিকে, প্রায় ক্রসকান্ট্রির ঢংয়ে আইওয়া, মিনেসোটা, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলিনা ও নিউ হ্যাম্পশায়ার চষে বেড়িয়েছেন ট্রাম্প৷ নির্বাচনের আগের রাতে ফিলাডেলফিয়ায় বিরাট সভার ব্যবস্থা করেছে হিলারি শিবির৷ হিলারি ছাড়াও বিল ক্লিনটন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ফার্স্ট লেডি মিশেল সেখানে উপস্থিত থাকবেন৷ প্রাইমারিতে হিলারির কাছে পরাস্ত হওয়া সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বিডেনরাও অনেকগুলি সভা করছেন৷ আবার আর্লি ভোটিং-এর হারে উৎসাহিত ট্রাম্প তথাকথিত ডেমোক্র্যাট ঘাঁটি মিনেসোটায় সভা করবেন৷ রিপাবলিকান শিবিরের দাবি, বহু ডেমোক্র্যাট অধ্যুষিত এলাকায় হয় তাঁরা সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছেন, নয়তো সামান্য এগিয়ে গিয়েছেন৷ দেশের মোট ৪৮টি প্রদেশের প্রায় কুড়ি কোটি ভোটার এবার ভোট দেবেন৷ তার মধ্যে চার কোটি মানুষ ইতিমধ্যেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন৷ কিন্তু মনে করা হচ্ছে, ‘ব্যাটেলগ্রাউন্ড’ ১৫টি প্রদেশই দুই প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে৷
(মঞ্চ থেকে নাটকীয়ভাবে নামানো হল ট্রাম্পকে)
অ্যারিজোনায় লাতিন আমেরিকান ভোটারদের সমর্থনে জিততে পারেন হিলারি৷ ১৯৯৬-এ বিল ক্লিনটনের পর কোনও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এখান থেকে জিততে পারেননি৷ ২০০৪-এ জর্জ ডব্লু বুশকে ঢেলে ভোট দেওয়া কলোরাডো পরের দু’বার ঢালাও সমর্থন দিয়েছিল ওবামাকে৷ এবারও হিলারির পক্ষেই তাদের থাকার সম্ভাবনা৷ ফ্লোরিডা হাতছাড়া হলে ট্রাম্পের পক্ষে কোনও আশাই প্রায় থাকবে না৷ এখানে লাতিন আমেরিকান ও অ্যাফ্রো-আমেরিকান ভোটারদের জন্য হিলারির জেতার সম্ভাবনা বেশি৷ জর্জিয়া যেমন ১৯৯২-এর পর থেকে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে নেই৷ কিন্তু আটলাণ্টায় এশীয়, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রভাব বাড়ায় ছবিটা পাল্টাতেও পারে৷ গত দু’বার ওবামার পক্ষে থাকলেও ট্রাম্পের অনেক আশা আইওয়াকে নিয়ে৷ প্রাইমারিতে মিশিগানে বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন হিলারি৷ সাধারণ নির্বাচনে তারই পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ লাস ভেগাস-সহ নেভাদার বড় অংশ ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে৷ আবার গ্রামীণ এলাকায় রিপাবলিকানদের পাল্লা ভারি৷ এখানে লড়াই হতে পারে হাড্ডাহাড্ডি৷
শেষ পাঁচটি ভোটে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে থাকলেও নিউ হ্যাম্পশায়ারে জোর লড়াই দিচ্ছেন ট্রাম্প৷ আবার নিউ মেক্সিকোয় হিলারিকেই এগিয়ে রেখেছে সমস্ত সমীক্ষা৷ নর্থ ক্যারোলিনার সমর্থন যে কোনও পক্ষেই যেতে পারে৷ তাই তা নিয়ে দুই প্রার্থীর মাথাব্যথারও অন্ত নেই৷ গত দু’বার ওবামার পক্ষে থকলেও চলতি নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে ট্রাম্পের পক্ষেই ছিল ওহায়ো৷ একইভাবে গত ছ’টি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে থাকলেও ট্রাম্প পেনসিলভানিয়াতে চমক দিতে পারেন৷ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ভার্জিনিয়াতেও৷ উইসকনসিনে রিপাবলিকান পার্টির জন্ম হয়েছিল৷ কিন্তু ১৯৮৪-র পর থেকে সেখানে ওই দলের কোনও প্রার্থী জিততে পারেননি৷ তবে রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ, শ্রমিক শ্রেণি এবার ট্রাম্পের প্রতি সদয় হতে পারেন৷
(১০০৮ নারকেল ফাটিয়ে হিলারির জয়ের কামনা শ্রীলঙ্কার তামিলদের)
The post মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্বে অনিশ্চয়তার আভাস appeared first on Sangbad Pratidin.