গৌতম ভট্টাচার্য: নিঃশব্দ বিপ্লব-ই কি ঘটে গেল ? নইলে বুধবার রোহিত গুরুনাথ শর্মার সাদা বলের ক্রিকেটে সর্বাত্মক অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পাওয়া ভারতীয় ক্রিকেটকে এমন কাঁপিয়ে দিয়েছে যে, রিখটার স্কেলে তার মাত্রা মাপলে খারাপ হয় না। সবাই জানতেন ভবিতব্য। বিরাটকে সরিয়ে দেওয়া হবে বলে। ‘সংবাদ প্ৰতিদিন’-এ গত ১৭ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল যে, টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ না জিতলে কোহলিকে (Virat Kohli) ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সি থেকেও ছেঁটে ফেলা হবে। তবু কোহলি এত বড় নাম। এমন প্রভাব তাঁর ভারতীয় জনজীবনে যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া সহজ কথা নয়। ছাঁটাই হব-হব অবস্থাতেও একটা চিন্তার তরঙ্গ তৈরি হয়েছিল যে, এখন তো বেশি ওয়ান ডে ম্যাচ নেই। এখনকার মতো বিরাটকেই রেখে পরে না হয় সিদ্ধান্তটা নেওয়া যাবে।
এত বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত চেতন শর্মার নির্বাচক কমিটি নিয়েছে বললে এটাও বিশ্বাস করতে হয় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম জো বাইডেন। নেয়নি। নিয়েছে ক্রিকেট বোর্ড। মনে রাখতে হবে এই ক্রিকেট বোর্ড প্রধানের নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কোচের নাম রাহুল দ্রাবিড় (Rahul Dravid)। একসঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটের অন্ধকার সময়ে দার্শনিক পরিবর্তন এনেছেন । একুশ বছর পর আবার জুড়ি অদম্য সাহসে এক হলেন ভারতীয় ক্রিকেটের নব যুগ আবাহনে। সচিব জয় শাহ বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিলেন বললে ভয়ঙ্কর ভুল বলা হবে। গত কয়েক বছর কোহলি তাঁর নানা আচরণে বোর্ড কর্তাদের এমন ক্ষিপ্ত করে দিয়েছেন। টিম পরিচলনায় এমন বিভেদ এনেছেন যে, টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে ভারতীয় জয়ও তাঁর গদি বাঁচাতে অসমর্থ।
তিন প্রাক্তন নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হল। নাহ, এঁরা কেউ আন্দাজ করতে পারেননি বিরাট কোহলিকে এখনই যে অতর্কিতে ভারতীয় ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন্সি থেকে ছেঁটে ফেলা হবে। নির্বাচক প্রধানদের মধ্যে বছরখানেক আগেও যিনি এই পদে ছিলেন সেই এমএসকে প্রসাদের কথা শুনে মনে হল, নিজে চেয়ারম্যান থাকলে কখনও এমন সিদ্ধান্ত নিতেন না। বললেন, ‘‘এত তাড়াহুড়োর তো কিছু ছিল না। সামনে সাত-আটটা ওয়ান ডে। সেটা না হয় বিরাটই ক্যাপ্টেন্সি করত। তারপর অস্ট্রেলিয়ায় টি টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপের রেজাল্ট দেখে আরামসে ওয়ান ডে ক্যাপ্টেন বাছা যেত।’’ চেন্নাইতে বসা কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত অত্যন্ত সতর্ক এবং না বুঝে ভারতীয় ক্রিকেটের এত বড় পালাবদল সম্পর্কে মন্তব্য করতে চাইছেন না। বললেন, ‘‘রোহিতকে স্বাগত জানাই। কিন্তু নিশ্চয়ই ওরা বিরাটের সঙ্গে আগে কথা বলেছে। আমি চেয়ারম্যান ছিলাম বলে জানি ব্যাকস্টেজে অনেক আলোচনার ব্যাপার থাকে। আপনারা ভাবেন এগুলো হুট্হুট করে হয়। তা নয়। বুঝিয়েটুজিয়ে পরিবর্তন আনা হয়।’’
[আরও পড়ুন: ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছাড়তে রাজি ছিলেন না কোহলি! জোর করেই নেতা বাছা হল রোহিতকে?]
মুম্বই থেকে দিলীপ বেঙ্গসরকর খুল্লামখুল্লা বললেন রোহিত (Rohit Sharma) অধিনায়ক হওয়ায় তিনি খুব খুশি। ‘‘ও যেভাবে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে নেতৃত্ব দিয়েছে। যেভাবে ও প্লেয়ারদের কথা ভাবে। ওদের সঙ্গে চলে সেটার স্বীকৃতি বোর্ড দিল দেখে আমি খুশি। রোহিতের বড় গুণ, ওকে প্লেয়াররা চাইলেই পেতে পারে। প্লেয়ার্স ম্যান ক্যাপ্টেন হল।” এর মানে যেটা বকলমে দাঁড়ায় সেটা বেঙ্গসরকর বলবেন না। তাহলে বিতর্ক হয়ে যাবে এবং জীবনের এই পর্যায়ে যে কোনও বিতর্ক চান না খোলাখুলি বললেন।
আমিরশাহি বিশ্বকাপের আগে টি টোয়েন্টি ক্যাপ্টেন্সি ছাড়ার কথা বিরাট নিজে বলেছিলেন। বুঝেছিলেন চাপের মুখে কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে যখন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনায় জানতে পারেন তাঁকে এই ফর্ম্যাট ছেড়ে দিতে হবে কার্যত স্তব্ধ হয়ে যান। কিছু পরে জানিয়ে দেন, এই সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিতে পারছেন না। রাজিও নন। বিসিসিআই কর্তারা ভেবেছিলেন, বিরাট নিজে থেকেই সরে যাবেন। কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে বেগড়বাঁই শুরু করায়, সিদ্ধান্ত হয় তাঁকে সরাসরি পদচ্যুত করা হবে। এখন তো শুধু টেস্ট ফর্ম্যাট হাতে থাকল তাঁর। বিপণনের বাজার সম্পূর্ণ সাদা বল কেন্দ্রিক। সেখানে তাঁর এতবছরের গুমোর-ই তো থাকল না। লাল বলে এখন শুধু প্রেস্টিজ। আর ঐতিহ্য। বিরাট মুখ্যত যে ঘরানার প্রতিনিধিত্ব করেন তার ছায়া পড়ে না টেস্টে।
এম এস কে প্রসাদ একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন এই বদলের। ‘‘দু’জন ক্যাপ্টেন এত ভিন্ন মেরুর যে ওদের হয়তো মনে হয়েছে সাদা বলে নেতা ভাগাভাগি করলে সংশয় তৈরি হবে। টিম বুঝবে না কীভাবে এগোবে? তাই হয়তো এখনই বদলাল।” তিনি হয়তো জানেন না যে রাহুল দ্রাবিড়ের বক্তব্যও এখানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলায় রোহিত মানে রক্তবর্ণ। রক্তবর্ণ ঝটিকাকে নিয়ে এখন রাহুল এগোতে চান। ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন সীমান্ত উন্মোচনে। টেস্ট ক্রিকেটে রোহিতকে সহ অধিনায়ক করা মানে ওখানেও তো ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবেন কোহলির। দুজনের কম্বিনেশন অল্পদিনেই জমে গ্যাছে। ভারতীয় ক্রিকেটের দিকরেখা এখন তাই আর প্লাস আর। রাহুল আরও একটা জিনিস কয়েকটা স্ট্রোকেই প্রমাণ করেছেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, কুম্বলে হতে তিনি আসেননি।