অরিঞ্জয় বোস: এ যেন অন্য এক ডার্বি। কুমোরটুলিতে এখন বিশ্বকর্মা বনাম গণেশ। চলছে জোর টক্কর। হিসাবমতো বিনা যুদ্ধে কারওরই জমি ছাড়ার কথা নয়। তবে এ-খেলার রেফারি অর্থাৎ কুমোরটুলির শিল্পীরা বলছেন, ইদানীং মাঠ জুড়ে যেভাবে দাপিয়ে খেলছেন গণপতি, তাতে বেশ কোণঠাসা বাবা বিশ্বকর্মা।
ভাদ্র মাসের মেঘ-কাটা রোদ্দুরের ঝিলিক মানেই কুমোরটুলিতে সাজো সাজো রব। আর কটাদিন পরেই বিশ্বকাপ থুড়ি মেগা ইভেন্ট দুর্গাপূজা। তার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। বায়নাপত্র এ-বছর এসেছে ভালই। করোনা-কাঁটা পেরিয়ে ইতিমধ্যে বিদেশেও পাড়ি দিয়েছে উমা। সে-কাজ তো চলছেই। তবে তার আগে এই আগস্ট শেষ-সেপ্টেম্বর শুরুর এই দিনকালে গণেশ-বিশ্বকর্মার টক্করে সরগরম থাকে কুমোরটুলি। মোটামুটি দিন পনেরোর এদিক ওদিকে দু’জনের পুজো, তাই প্রস্তুতিপর্বে পাশাপাশিই থাকেন দু’জন। ছোট ছোট বিশ্বকর্মা আর গণেশের মূর্তি যেন মিছিল করে দাঁড়িয়ে থাকে, হাতি আর ইঁদুরের অনন্য সহাবস্থান। সেই চেনা ছবি এবার অনেকটাই বদলেছে। বদল অবশ্য গত কয়েকবছর ধরেই টের পাওয়া যাচ্ছিল, তবে এবার চোখে পড়ার মতোই বদলেছে কুমোরটুলিতে দেবতার জন্ম।
[আরও পড়ুন: বৃষ্টিতে ভিজে জুতো-মোজায় দুর্গন্ধ? এই ৬ সহজ উপায়ে দূর করুন সমস্যা]
মূলত, দু-ভাবে গণেশ টেক্কা দিয়েছেন বিশ্বকর্মাকে। সংখ্যায় আর চেহারায়। প্রায় সব শিল্পীরাই বলছেন, গণেশের অর্ডার এবার বেশ বেড়েছে। তুলনায় বিশ্বকর্মার চাহিদা যেমন ছিল তেমনই বরং খানিকটা কমেইছে। সবথেকে বেশি বদল এসেছে গণেশের চেহারায়। বাঙালির হালখাতায় কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা গণেশ কিংবা কলাবউয়ের পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা নাদুসনুদুস গণেশের দিন গিয়েছে। পরিবর্তে যেরকম গণেশ তৈরি হচ্ছে, তা বিশ্বকর্মার উচ্চতার প্রায় দেড় কি দুই গুণ। সেই অনুপাতে বেড়েছে স্থূলত্বও। অনেকটা মুম্বইয়ে গণেশ চতুর্থী (Ganesh Chaturthi 2022) পালনে যেরকম মূর্তি দেখা যায়, সেরকমই বড়সড় চেহারার গণপতির চাহিদাই এখন তুঙ্গে। বিশালবপু এই গণেশকে জায়গা করে দিতে শিল্পীদের ঘরে ঘরে বিশ্বকর্মা আক্ষরিক অর্থেই কোণঠাসা। অর্ডারের সংখ্যাও কম হওয়ায়, পুজোর আগে কুমোরটুলির বাজার যে তাঁর থেকে গণেশের দিকেই ঝুঁকেছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে ইতিউতি কথা বলে জানা গেল, এক দশকে বদলে গিয়েছে চালচিত্র। বড়সড় গণেশ মূর্তির অর্ডার আগে এলেও, সংখ্যায় তা বেশি ছিল না। বরং পাড়ায় পাড়ায় বিশ্বকর্মা পুজোর দরুন, ওই মূর্তিই বেশি তৈরি হত। জনৈক শিল্পী জানাচ্ছেন, দশ বছর আগে হাতে গোনা কয়েকটি বড় গণেশ মূর্তির অর্ডার মিলত। বরং কুমোরটুলির ঘরে ঘরে বিশ্বকর্মা মূর্তিই তৈরি হত বেশি। যেখানে আগে গড়ে যে-কোনও শিল্পীর ঘরে বিশ্বকর্মা (Vishwakarma) হত চল্লিশটির বেশি, এবারে সেই সংখ্যাটা বরাদ্দ হয়েছে গণেশের জন্য। বিশ্বকর্মার অর্ডার বরং এখন হাতে গোনা। শিল্পীরা বলছেন, চোখে পড়ার মতো বদল হয়েছে গত পাঁচ বছরে। প্রায় প্রত্যেক শিল্পীর ঘরেই অর্ডারের নিরিখে বিশ্বকর্মাকে ছাপিয়ে গিয়েছেন গণেশ। আরও একটি সমস্যার কথা উল্লেখ করছেন শিল্পীরা। গণেশমূর্তির অর্ডার বেশি হওয়ায়, গণেশ তৈরি করতেই সময় কাবার হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিশ্বকর্মা প্রায় তৈরিই করছেন শিল্পীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, এখন জেলার দিকে বিশ্বকর্মার চাহিদা থাকলেও, কুমোরটুলিতে বিশ্বকর্মার পুরনো দাপট প্রায় ফিকে। সেই সঙ্গে গণেশের মূর্তি থেকেও উধাও হয়েছে বাঙালিয়ানার ছাপও। যেরকম বড় মূর্তি এখন কুমোরটুলির ঘরে ঘরে তার চল বেড়েছে গত পাঁচ বছরেই।
শিল্পীদের এই কথা শুধু কুমোরটুলির নয়, সামগ্রিক এক সাংস্কৃতিক বদলেরও ইঙ্গিত দেয়। বিশ্বকর্মা মূলত সর্বসাধারণের দেবতা। বড় প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রমিকবর্গ, সকলেই তাঁর আরাধনা করেন। অন্যদিকে, বাঙালির গণেশ আরাধনা মূলত পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়ায়। তবে এখন মুম্বইয়ের ধাঁচে গণেশ চতুর্থী পালনের হিড়িকে বোঝা যায়, বাঙালি তার সাংস্কৃতিক রীতি থেকে বেশ খানিকটা সরেছে। ছোট, মাঝারি শিল্পের প্রতি অবলম্বন অনিবার্য কারণেই আর বাঙালির উপার্জনের রাস্তা নয়। ফলত বিশ্বকর্মাপুজোর সর্বজনীনতা অনেকটাই ম্লান। অন্যদিকে এ বঙ্গে ব্যবসা, বিনিয়োগে এখন বেশ এগিয়ে তাঁরা, যাঁরা হয়তো জন্মসূত্রে বাঙালি নন। তবে কর্মসূত্রে যেহেতু তাঁরা বাংলাকেই আপন করে নিয়েছেন, তাই তাঁদের সংস্কৃতির ছায়াও এসে পড়েছে গঙ্গাপারে। কেউ কেউ আবার বলছেন, এই সংস্কৃতি বদলের শিকড় আছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গভীরে।
[আরও পড়ুন: ‘ভারতীয় ফুটবলকে ডোবানোর চেষ্টা করছেন আপনি’, সুপ্রিম ভর্ৎসনার মুখে প্রফুল্ল প্যাটেল]
সব মিলিয়ে বিশ্বকর্মা-গণেশ দ্বৈরথে কুমোরটুলির আকাশ অংশত মেঘলা। দিনবদলের সাক্ষী হয়ে ঘনিয়ে-ওঠা এক মিশ্র সংস্কৃতি বুকে নিয়েই দিনযাপন শিল্পীমহলের। গণপতি বা বিশ্বকর্মা যেই দাপট দেখান না কেন, কাজ যে আসছে, এটাই তাঁদের কাছে বড় কথা। তবে, এসবের ভিতর গণপতি বাপ্পায় বিশ্বকর্মা বেজায় খাপ্পা কি-না, সে ইতিহাস বরং গোপন থাকাই ভাল।