শ্রেণিশত্রুর শাস্তি খুন। হঠাৎ হানা। ‘বিচারে’র নামে হত্যালীলার দিনগুলি এখন অতীত। দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে জঙ্গলমহলে এখন অন্য আলো। তবুও কিছু অন্ধকার ঘিরে থাকে লালমাটির জেলাগুলোর গ্রাম। ভোটের সময় সেই পথে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর যাত্রা।
সুমিত বিশ্বাস ও দেবব্রত দাস, পুরুলিয়া ও খাতড়া: সেদিনের শ্রেণিশত্রু আজ ‘বন্ধু’! আরও ভেঙে বললে – সহকর্মী। বান্দোয়ান থানার যে ওসিকে ল্যান্ডমাইনে উড়িয়ে দিয়েছিল নকশালরা, গুলি করে মেরেছিল সারেঙ্গা থানার আইসি রবিলোচন মিত্রকে। সেই পুলিশই আজ সহকর্মী। মাওবাদী (Maoist) মোকাবিলার ‘নীল নকশা’ সাজিয়ে পুলিশকেই নকশাল দমনের পাঠ দিচ্ছেন একদা সিপিআই (মাওবাদী)-এর মিলিটারি কমিশনের প্রধান রঞ্জিত পাল ওরফে নীতীন ওরফে রাহুল ওরফে সঞ্জয় ওরফে রোহিত ওরফে রাজা ওরফে তড়িৎ ওরফে পশুপতি ওরফে পনরু ওরফে প্রভাতজি। এটাই বদলে যাওয়া জঙ্গলমহলের ছবি।
একদা সিপিআই (মাওবাদী) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য, সেই সঙ্গে বাংলার সংগঠনের মিলিটারি কমিশনের প্রধান আজ মূল স্রোতে। তাই দক্ষিণ বাঁকুড়ার (Bankura) বারিকূলের খেজুরখেন্নার বাসিন্দা রঞ্জিত পাল এখন মাওবাদী দমনে মোতায়েন বাহিনীর সঙ্গে চষে বেড়াচ্ছেন জঙ্গল। আগে শ্রেণিশত্রুকে খতম করতে ঘন জঙ্গলে লতাপাতায় মিশে ওৎ পেতে বসে থাকতেন। আর এখন নিজের পুরনো সংগঠনকে দমন করতে খসড়া তৈরি করে দিচ্ছেন। সাজিয়ে দিচ্ছেন অপারেশনের ছক। এটাই বদলে যাওয়া জঙ্গলমহল। যে ‘সাদা পোশাক’ বিপ্লবী জীবনে একেবারেই নিষেধ ছিল, সহজে চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে শরীরে সাদা রঙের পোশাক জড়ানো যেত না, এখন শ্যাওলা সবুজ পোশাক ছেড়ে সেই সাদা পোশাকেই এক অন্য চেহারায় পুলিশের সঙ্গী। গ্রামের পর গ্রাম, জঙ্গলের পর জঙ্গল কালাশনিকভ নিয়ে মশাল হাতে যিনি মিছিল করে এই সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখাতেন, মিটিং করে বুথে পা রাখতে দিতেন না ভোটারদের, ভোট বয়কটের ‘ফতোয়া’ দিতেন, এখন সেই প্রাক্তন মাওবাদী নেতাই জঙ্গলমহলে যাতে যৌথ বাহিনী সুষ্ঠুভাবে ভোট পার করতে পারে, তার পরিকল্পনা রূপায়ণ করছেন। জঙ্গলমহলের এটাই বদলে যাওয়া ছবি।
[আরও পড়ুন: ‘ঝুলছে তোর ওই উন্নয়ন’, দিনহাটায় বিজেপি কর্মীর রহস্যমৃত্যুতে মমতাকে তীক্ষ্ণ নিশানা দিলীপ]
তিনি যে স্পেশ্যাল হোমগার্ড। খাতায়-কলমে বাঁকুড়া কর্মস্থল হলেও মাওবাদী দমনে কখনও কলকাতায় গোয়েন্দা দপ্তরে, কখনও মাও দমনে মোতায়েন সিআইএফ-এর অফিসে। কখনও আবার পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে গিয়ে ঘন দুর্গম জঙ্গল চিনিয়ে দিচ্ছেন। চিনিয়ে দিচ্ছেন পাহাড়-জঙ্গলের শটকার্ট রুট। এটাই জঙ্গলমহলের (Jungalmahal) বদলে যাওয়া চিত্র।
তাই বদলের জঙ্গলমহলে প্রাক্তন মাওবাদী রঞ্জিত পালও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন। তাঁর হাতেও রয়েছে ভোটার কার্ড। ভোটের বিরোধিতা করা, গণতন্ত্র না-মানা চল্লিশোর্ধ্ব ছেলের এমন বোধোদয়ে আজ চিন্তামুক্ত মা। দিনের পর দিনের অজানা আশঙ্কা, ভয়, উদ্বেগ কাটিয়ে মা অলোকা পালের মুখে এখন হাসি। কারণ, আর তাঁর বড় ছেলেকে খুঁজতে পুলিশ আসে না। আসে না সিআরপিএফ। বরং পুলিশই তাঁকে পাহারায় এসকর্ট করে নিয়ে আসে। তাই মা বলেন, “তোমরা বলেছিলে ছেলেটা মারা গিয়েছে। ও তো মমতার কাছে গিয়ে বন্দুক জমা করে এসেছে। এখন ‘পুলিশ’ হয়েছে। ভোটও দিচ্ছে। এই তো বেশ কিছুদিন আগে বাড়ি এসেছিল।” মায়ের এমন খুশি দেখে এখন অনেকটাই নিশ্চিন্তে ঘুমায় জঙ্গলমহল। এখন আর সন্ধেবেলাই রাত নামে না অযোধ্যা পাহাড়ে, বারিকূলে, বেলপাহাড়িতে।