প্রয়াত গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তাঁর স্মৃতিচারণায় কলম ধরলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সন্ধ্যাদির প্রয়াণে আমি আত্মীয় বিয়োগের যন্ত্রণা অনুভব করছি। উনি আমাকে মাতৃস্নেহ দিয়েছিলেন। মেয়ের মতো ভালবাসতেন। বাংলার সংগীত জগতে আজ বড় দুঃখের দিন। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী গীতশ্রীকে আমরা হারালাম। আমাদের হৃদয় আজ শূন্য। ছেলেবেলা থেকেই সন্ধ্যাদির গানের সঙ্গে আমার পরিচয়। ওঁর সুরেলা কণ্ঠ সিনেমার চরিত্রগুলোতে প্রাণ সঞ্চার করত। শুধু সিনেমা কেন বলব, আধুনিক বাংলা গানও তাঁর কালজয়ী। সন্ধ্যাদির আলাদা একটা ঘরানা। বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম-সুচিত্রা যেমন একটা জুটি, তেমন হেমন্ত-সন্ধ্যাও সমান সফল জুটি। সন্ধ্যাদি যেমন রাগ সংগীত গেয়েছেন, তেমনই তাঁর আধুনিক বাংলা গান চিরন্তন হয়ে আছে। তাঁর গানে যেন জীবনের কথা লেখা থাকত। এত সুর, এত ভাব, গলায় এত মাধুর্য তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। আমি তন্ময় হয়ে আজও রোজ ওনার গান শুনি।
কতগুলি গান আমার হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। যেমন মান্না দের সঙ্গে একটি মঞ্চে উনি ডুয়েট গেয়েছিলেন। সেই গানটা ছিল ‘আমায় চিরদিনের সেই গান বলে দাও’। মুগ্ধ হয়েছিলাম। আরেকটি গান ‘এসো মা লক্ষ্মী’, ‘শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনেছি’– বাঙালির ঘরে ঘরেই তো এই গান বাজে। সন্ধ্যাদি বাংলার গর্ব শুধু নয়, প্রকৃত অর্থেই ভারতরত্ন। উনি শেষ জীবনে মাথা উঁচু করে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, কতটা দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বোঝালেন সব সম্মানের ঊর্ধ্বে তিনি। আর সব সম্মান সম্মানের নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের এটা বোঝা উচিত ছিল।
[আরও পড়ুন: প্রয়াত বাপি লাহিড়ী, ফের নক্ষত্রপতন সংগীত দুনিয়ায়]
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এক কালোত্তীর্ণ শিল্পী। এমন কণ্ঠ বারবার আসে না। একসময় সন্ধ্যাদি হিন্দি গানও গেয়েছেন। স্বয়ং লতাজির সঙ্গে তাঁর ডুয়েট গান আছে। সেই গান বিখ্যাত হয়েছিল। সেই লতাজি ও সন্ধ্যাদিও পরপর কয়েকদিনের ব্যবধানে চলে গেলেন। পুরো শতাব্দীজুড়ে তাঁরা ছিলেন। এ ক্ষতি তো শুধু দেশের ক্ষতি নয়। সত্যি কথা বলতে কী, কালজয়ী অনেক শিল্পী আছেন। তাঁদের মধ্যে ইন্দ্রধনু কিন্তু সন্ধ্যাদিই। আমার আজ ভাবতে গর্ব হয় উনি আমাদের জাগোবাংলার উৎসবসংখ্যা প্রকাশ অনুষ্ঠানে আসতেন।
মহালয়ার বিকেলে সন্ধ্যাদি আর দ্বিজেনদার যুগলবন্দি দেখতে উপচে পড়ত নজরুল মঞ্চ। কত পুরনো কথা সেসব অনুষ্ঠানে উঠে এসেছে। আজ স্মৃতি রোমন্থন করছি। ওঁরা দু’জনে শোনাতেন আকাশবাণীতে মহিষাসুরমর্দিনীর রিহার্সালের ঐতিহাসিক ঘটনা। ওই দিনগুলো মনে পড়ছে আর এই লেখা লিখতে লিখতে আমার গায়ে কাঁটা দিত। গত দু’বছর তিনি আসতে পারেননি অসুস্থতার জন্য। কিন্তু খবর নিতেন। আমার সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ থাকত। আমার এখনও মনে পড়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো ছিলেন। মাঝেমাঝেই ফোন করে বলতেন ‘মমতা একটা গান শোনাও না’। আমি বলতাম সন্ধ্যাদি আমায় গান শোনাতে বলছেন? আপনি সংগীত জগতের দিশারি। শুনতেন না। ‘গাও না, গাও না’-এরকম করতেন। সন্ধ্যাদিকে আমায় গান শোনাতে হয়েছে!
অসুস্থ হওয়া থেকে ওনার খবর আমি রাখছি। ওনার চিকিৎসার দিকে আমার নজর। আমি ভাবতে পারিনি উনি চলে যাবেন। অস্ত্রোপচার ঠিকঠাক হল। মাঝে ভালই হয়ে গিয়েছিলেন। কোভিডমুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে গ্যাস্ট্রাইটিসের সমস্যা ছিল। সেটা যে এত তাড়াতাড়ি খারাপের দিকে যাবে বুঝতে পারিনি। আমরা ভেবেছিলাম যে, আরেকটু সময় পাব। কোভিডের জন্য আমরা তাঁকে এসএসকেএমে করতে পারিনি। না হলে ওখানে আমাদের লিভারের ভাল ডাক্তার ছিলেন গোপালকৃষ্ণ ঢালি। ডাক্তার ঢালিকে পাঠাব ঠিক করলাম, তখন জানতে পারলাম উনি আর নেই।
আমার সব থেকে খারাপ লাগছে যে, মানুষটা এত নিয়ম মেনে চিকিৎসার সময় সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন। ঠিকমতো খাচ্ছিলেন। রক্তচাপ ঠিক ছিল। হঠাৎ একদিনে কী হল জানি না। পরে জানতে পারব।
আমার কোচবিহারে কর্মসূচি ছিল। কলকাতায় ফেরার কথা ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু আমি ভারাক্রান্ত। ভাবতেই পারছি না সন্ধ্যাদি নেই। বুধবারের অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শেষ করে যেভাবেই হোক আমি কলকাতায় ফিরছি। রাতে পিস ওয়ার্ল্ডে তাঁর মরদেহ রাখা হয়। বুধবার ১২টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত মরদেহ রবীন্দ্রসদনে থাকবে। ওনার গুণমুগ্ধরা যাঁরা আছেন শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে তাঁর শেষযাত্রার কাজগুলো রাজকীয়ভাবে করা হবে। রাজ্যের যে সর্বোচ্চ সম্মান গান স্যালুট সেটা দিয়েই তাঁর শেষযাত্রা হবে। সব থেকে ক্ষতি হল ওদের পরিবারের। তাঁদের প্রতি আমার সম্পূর্ণ সমবেদনা রয়েছে। আর ক্ষতি হল বাংলার সংস্কৃতির।
আমার বিশ্বাস সন্ধ্যাদি অমর। তিনি মৃত্যুহীন। সারা জীবন তিনি আমার হৃদয়ে মননে চেতনায় থাকবেন।