কৃষ্ণকুমার দাস: ঐতিহাসিক কপালকুণ্ডলা মন্দির ও জাতীয় সড়ক থেকে দরিয়াপুর গ্রামে যাওয়ার রাস্তা দ্রুত সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। শুধু তাই নয়, স্বয়ং সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ডাকাতির তদন্তে জলাজঙ্গল ঘেরা যে গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকদিন ছিলেন সেই জনপদ ঘিরেও তৈরি হবে পর্যটন ক্ষেত্র। মন্দির থেকে সামান্য দূরে যে পেটুয়াঘাট লাইট হাউস ও মৎস্যবন্দর রয়েছে তা জুড়ে নবনির্মিত মেরিন ড্রাইভকে মিলিয়ে চালু হবে পর্যটন সার্কিট। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসককে কপালকুণ্ডলা মন্দির ও রাস্তা সংস্কার নিয়ে রাজ্যের এমনই সদিচ্ছার কথা জানিয়েছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন কমিটি।
কাঁথির পেটুয়াঘাট মৎস্যবন্দর থেকে সভা করে ফেরার পথে রহস্যের টানে দরিয়াপুর গ্রামে গিয়েছিলেন কুণাল ঘোষ ও ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যসভার দুই প্রাক্তন সাংসদ। গা ছমছম পরিবেশ, ঘন জঙ্গল ও গাছপালা ভরতি মন্দির চত্বরে পা রেখে শিউরে ওঠেন দু’জনেই। চুন-সুড়কির মশলায় ভরা পাতালা ইটের গাঁথুনিতে ঘরে দেড়শো বছরের পুরানো চণ্ডীমন্দির দেখে রোমাঞ্চিত হন। আচমকাই সেখানেই হাজির হন ভূদেব জানা নামের এক অশীতিপর বৃদ্ধ। তিনিই শোনান, ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই মন্দিরে থাকতেন এক তান্ত্রিক কাপালিক ও তাঁর পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা। গ্রামে আসা মেদিনীপুরের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্রকে পর পর তিন রাতে সমুদ্র মোহনার হোমযজ্ঞে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিলেন ওই তান্ত্রিক। কিন্তু বঙ্কিমকে না যাওয়ার জন্য সন্ধের পর এসে প্রতিদিনই সাবধান করে গিয়েছিলেন সাদা শাড়ি পরা মুখ ঢাকা এক রহস্যময়ী নারী। ভূদেব জানার পাশাপাশি স্থানীয় সূত্রে এমন চমৎকৃত কাহিনী শুনে এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক উপন্যাসের গর্ভগৃহের জীর্ণ দশা দেখে তৎপর হন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। কপালকুণ্ডলার মন্দির ও সংলগ্ন বাড়ির কাঠামো সংস্কারে ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করেন তিনি। গোটা তথ্য শুনে হস্তক্ষেপের আশ্বাস দেন চেয়ারম্যান।
[আরও পড়ুন: ৫০ জন ঋণখেলাপীই আত্মসাৎ করেছেন দেশের ৯২ হাজার কোটি টাকা! শীর্ষে মেহুল চোক্সি]
মঙ্গলবার সকালে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ ‘নবকুমারকে নিয়ে কপালকুণ্ডলার পালিয়ে যাওয়া’ শীর্ষক সংবাদে কুণালদের মন্দির পরিদর্শনের সংবাদ প্রকাশ হয়। আর বিকেলেই রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যানের তরফে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাঝিকে চিঠি পাঠায় কমিটি। সরজমিনে পরিস্থিতি ও মন্দিরের পরিকাঠামো পরিদর্শন করে কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে দ্রুত রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়েছে জেলাশাসককে। লেখা চিঠিতে কমিশনের সচিব জানিয়েছেন, “কাঁথির দরিয়াপুরের কপালকুণ্ডলা মন্দিরের কাঠামো বেহাল হয়ে পড়ায় দ্রুত মেরামত প্রয়োজন। পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটিও খুবই খারাপ, সংস্কার করা দরকার। কপালকুণ্ডলা মন্দিরের পাশাপাশি কাছের পেটুয়াঘাট লাইটহাউস ও মৎস্যবন্দর নিয়ে একটি পর্যটন ক্ষেত্র চালু করা যেতে পারে।” কপালকুণ্ডলা মন্দির ঘিরে এদিন থেকে তৎপর হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলাপরিষদ এবং স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতিও।
[আরও পড়ুন: তাওয়াং নিয়ে কেন নীরব কেন্দ্র, প্রশ্ন তুলে গান্ধীমূর্তির নিচে বিক্ষোভ বিরোধীদের]
ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ উদ্যোগে দিঘা থেকে মন্দারমণি ছুঁয়ে কাঁথির সৌলা হয়ে জুনপুট পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ চালু হয়েছে। সাজিয়ে তোলা হয়েছে দিঘা ও সংলগ্ন সমুদ্র উপকুল। বাকি ১৬ কিমি মেরিন ড্রাইভও চালু হয়ে গেলে দিঘা বা মন্দারমণিতে আসা পর্যটকরা সমুদ্র উপকুল ধরেই গাড়ি নিয়ে সটান চলে আসতে পারবেন বহু বিশ্রুত কপালকুণ্ডলা মন্দিরে। দেখতে পারবেন পেটুয়াঘাট লাইট হাউস ও মৎস্যবন্দর। ইচ্ছে হলে ভূদেব জানার মতো কারও কাছে পর্যটকরা শুনতে পারবেন, ‘পথিক, তুমি কী পথ হারাইয়াছো?’ কাহিনীর স্রষ্টাকে ঘিরে দরিয়াপুরের জঙ্গলে মিশে থাকা নানা রহস্য-গল্প।