বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: ‘খেলা হবে’ স্লোগানে বিরক্ত মাঝবয়সি ভোটারদের বড় অংশ। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদের প্রশ্ন, সাধারণ মানুষের গভীর সমস্যাগুলির প্রসঙ্গ ছেড়ে এমন ‘অশ্লীল’, ‘চটুল’ স্লোগানের কি খুব প্রয়োজন ছিল?
যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে একটি রাজ্যের অনেক সমস্যা থাকে। প্রয়াত প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র একসময় কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস চেয়ে সরব হয়েছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনের (WB Polls 2021) প্রচারেও তা ঝড় তুলেছিল। বুঝে, না বুঝে জটিল ওই প্রসঙ্গ চায়ের আড্ডায় নেমে এসেছিল। এখন সেই জায়গা দখল করল চটুলতা। এমনই অভিযোগ নতুন প্রজন্মের ভোটদাতাদের একাংশের। আবার বিদ্বজ্জনরা মনে করছেন, ভোটের প্রচারে চটুলতার নামে অসহিষ্ণুতা অশুভ ইঙ্গিত।
যেমন, জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী পিংকি সরকার বলেন, “ভোটে রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কথা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যে কৌতুক, হেঁয়ালি থাকে, সেটাও রাজনীতিকেন্দ্রিকই হওয়া উচিত। কিন্তু এবার সে সবের বালাই নেই। ‘খেলা হবে’ বলে চিৎকার চলছে। এটার মানে কী!” আবার শিলিগুড়ি কলেজের সুদেষ্ণা দত্ত মনে করেন, গণতন্ত্রকে খেলায় নামিয়ে আনা ঠিক নয়। রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলেই এমন অপ্রয়োজনীয় উসকানিমূলক কথা রাজনৈতিক স্লোগানে জায়গা করে নিচ্ছে। তিনি বলেন, “ভোটের প্রচারে আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ, কটাক্ষ সবই থাকবে। কিন্তু সেটা মার্জিত হওয়াই উচিত। প্রতিহিংসা থাকলেই বিপদ।” রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীপক রায় আরও খোলসা করে বলেন, “ভোটে প্রচারের নামে যা চলছে, সবটাই অসহিষ্ণুতার লক্ষণ। সামাজিক অসুস্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব শুনে ভোটদাতা শুধু বিভ্রান্তই হবেন।”
[আরও পড়ুন: ভোট ঘোষণার পর প্রথম রাজ্য সফরে অমিত শাহ, রবিবার তারকা প্রার্থী হিরণের হয়ে প্রচার]
উত্তরবঙ্গে (North Bengal) ৫৪টি বিধানসভা আসনের প্রায় প্রতিটিতেই অন্তত পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি ভোটদাতা ওই ধরনের মতামত পোষণ করছেন বলে একটি বেসরকারি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে। ওই কারণে রাজনৈতিক সভা-সমিতি নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কমছে। যেমন কোচবিহার জেলায় ৯টি বিধানসভা আসনে ভোটদাতা ২৩ লক্ষ, ৩৯ হাজার ১৭১। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার নতুন। ওই ভোটদাতাদের বেশিরভাগ রাজনৈতিক প্রচার নিয়ে উদাসীন।
গণতন্ত্র এবং অশ্লীলতা পাশাপাশি চলতে পারে না বলে মনে করেন অর্থনীতির গবেষকদের একাংশ। তাঁদের কথায়, গণতন্ত্র হল সভ্যতার সেরা অবদান। সেটাকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। ‘আমি কোবরা’, ‘মারব এখানে…শ্মশানে’, ‘খেলা হবে’– এসব ভোটের প্রচারে চলতে পারে না। জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, “ভোট সিনেমার পর্দা নয়। এটা গণতন্ত্রের সেরা উৎসব। সেটাকে যেভাবে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগে কলঙ্কিত করা হচ্ছে মেনে নেওয়া যায় না। সচেতন নাগরিকদের উচিত, ওই সমস্ত নেতাদের বয়কট করা।” কিন্তু সেটা সম্ভব হবে বলে মনে করেন না উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী নিবেদিতা ঘোষ। তিনি বলেন, “এখানে ভোটের পরিবেশ অনেকদিন আগের বিহার ও উত্তরপ্রদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। হুমকি, চাপা উত্তেজনা, মারপিট ছাড়া ভোট হয় না। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষের মনে রয়েছে। কিন্তু এসব করে লাভ কী!”