দীপঙ্কর মণ্ডল ও মণিশঙ্কর চৌধুরী: খেজুরি কলেজ ডান দিকে রেখে পূব দিকে পাকা রাস্তা। নন্দীগ্রামে (Nandigram) রাজনৈতিক মহাযুদ্ধের আগের সন্ধে। জমজমাট তিনমাথার মোড় তেঁতুলতলা। মিনিট পাঁচেক এগোলে তেখালি। এখান থেকে তালপাটি খাল পেরোলেই নন্দীগ্রাম। এই মুহূর্তে যেন ইজরায়েল থেকে প্যালেস্তাইনের প্রবেশপথ। যেন বিবদমান দুই দেশের সীমান্ত। এপারে ভোট মিটেছে। ওপার অপেক্ষায়। গোটা দেশের নজর এখন এখানেই।
তেখালি ব্রিজের ওপর সশস্ত্র প্রহরা। অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে অগুনতি জওয়ান। নির্বাচন কমিশনের (Election Commission) অনুমতিপত্র খুঁটিয়ে দেখার পর মিলল নন্দীগ্রামে ঢোকার অনুমতি। চারিদিক শুনশান। কানে আসছে ভারি বুটের আওয়াজ। গোটা বিধানসভা জুড়ে ১৪৪ ধারা। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। ফাঁকা রাস্তা। খানিকটা এগোলেই মহেশপুর তারপর আমগাছিয়া। কমিশনের খাতায় এলাকার প্রত্যেকটি বুথ অতি স্পর্শকাতর। এই দুই জায়গাকে বলতে হবে ‘সুপার সেন্সেটিভ।’ অন্ধকার রাস্তা। গাড়ির হেডলাইটে দেখা যাচ্ছে রাস্তার দু’দিক মুড়ে ফেলা হয়েছে গেরুয়া পতাকায়। পরিস্থিতি বুঝতে গাড়ি থামল। অন্ধকার চিরে হাজির জনা কুড়ি যুবক। খাড়া পাহাড়ের খাদের কিনারে হঠাৎ একদল লোক উঠে এসে যে চমক দেয়, সেই হাল হল। আমগাছিয়ার এই যুবকদের অভিযোগ, তাঁদের বুথের দুজনকে তুলে নিয়ে গিয়েছে তৃণমূল। তখনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দিয়ে গাড়ি ছোটাই গড়চক্রবেড়িয়ার দিকে। এই এলাকা তৃণমূলের পতাকায় ভরা। বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী দিনভর নন্দীগ্রামেই ছিলেন। দলীয় কর্মীদের সঙ্গে সিরিয়াস আলোচনায় আমাদের ঢোকার সুযোগ হয়নি। মোর্চা প্রার্থী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় (Minakhshi Mukherjee) রেয়াপাড়ার নির্যাতিতাকে দেখতে তমলুক হাসপাতালে গিয়েছিলেন। পরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পার্টি অফিস হয়ে রাত পর্যন্ত নন্দীগ্রাম দলীয় কার্যালয়ে বসে ৩৫৫টি বুথের খবর নিচ্ছিলেন। সব ঠিক আছে তো? প্রশ্নে অনাবিল হাসিতে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন সিপিএমের যুবনেত্রী। তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের অন্য কয়েকটি কেন্দ্রে প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। নিজের জাহাজ বাড়ির অফিসে বসে মমতার ইলেকশন এজেন্ট শেখ সুফিয়ান শেষ মুহূর্তের ভোট মেশিনারি নিয়ে ব্যস্ত। দুপুরে গিয়েছিলাম সোনাচূড়ায় জমি আন্দোলনের প্রথম শহীদ ভরত মণ্ডলের বাড়িতে। ১৪ বছর আগে বিধবা হওয়া মৃত ভরতের স্ত্রী রিঙ্কু মণ্ডল মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি একরাশ ক্ষোভ উগরেছেন। ক্ষতিপূরণ জোটেনি, রাজ্য সরকার খোঁজটুকুও নেয়নি, দাবি করেছিলেন শহীদ জননী সৌদামিনী মণ্ডল। এসব ক্ষোভের কথা শুনে মমতার ইলেকশন এজেন্ট কয়েক সেকেন্ড ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। শান্ত গলায় সুফিয়ান বললেন, “ওই শহীদ পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে বিজেপিমুখী করা হয়েছে। আমরা টাকা দিয়েছি। মৃত ভরতের স্ত্রীকে অঙ্গনওয়াড়িতে চাকরিও দিয়েছি।”
[আরও পড়ুন: ‘বিজেপির বিরুদ্ধে একত্রিত হোন’, একযোগে ১৫ জন বিরোধী নেতাকে চিঠি মমতার]
নন্দীগ্রামে এবারের ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা আছে। দারিদ্র, দুর্নীতি, ভাঙা রাস্তা, বেকারি, কথা না রাখা, চিকিৎসা, স্কুল-কলেজ, লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিক, আমফান, কাজ হারানোর কথা যেন ফিকে হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে লবণ সত্যাগ্রহ, তেভাগা ও জমি আন্দোলনের ধাত্রীভূমি। তৃণমূল-বিজেপির হেভিওয়েট নেতা-নেত্রীদের যাওয়া আসায় আলাদা আলাদা হেলিপ্যাড দেখলাম। গত কয়েকদিন বেশ বড় বড় রঙিন জমায়েত হয়েছে। তবে ভিড় দেখে হাওয়ার গতিপথ বোঝা দুঃসাধ্য। নির্বাচনী প্রচার শেষ। কয়েক ঘন্টা পরে ভোট। খালি পায়ের কৃষক, কলেজে পড়া তরুণী, ছোট্ট গুমটি নিয়ে বসা মা, ১৪ বছর আগে জমি রক্ষায় রক্তঝরা পরিবার, এমন অগুনতি মানুষ অপেক্ষায়, ভালোয় ভালোয় মিটে যাক নির্বাচন। সকালে ঘোলপুকুর বাজার হয়ে ঢুকে মাটির দাওয়ায়, চায়ের দোকানে, স্কুলের মাঠে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যতজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবাই যেন কেমন গুটিয়ে ছিলেন। দিনভর সাউদখালি, কেন্দেমারি, রানিচক, টাকাপুরা, আমদাবাদ, খোদামবাড়ি, রেয়াপাড়া, শিবরামপুর, সুবদি, কালিচরণপুর, গোকুলনগর, মহেশপুর, আমগাছিয়ায় দেখেছি গোটা বিধানসভা এলাকা থমথমে। সোনাচুড়ায় রাতে বোমা সহ গ্রেফতার নাড়ু দাস নামে এক যুবক। তৃণমূলের অভিযোগ, সে বিজেপি কর্মী। নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ড হয়ে ভাঙাবেড়া ফেরার পথে গাংড়া। রাত তখন প্রায় ন’টা। মাটির উঠোনে আদুল গায়ে বসে দেবেন্দ্রনাথ মাইতি ও ঋতিশ মণ্ডল। দুজনে এই এলাকায় তৃণমূলের দুই বুথের দায়িত্বে। সল্প আলোয় নিজের হাত, পা আর পিঠের ক্ষত দেখালেন মাঝবয়সি ঋতিশ। বিজেপি সমর্থিত দুষ্কৃতীরা তাঁর এই হাল করেছে বলে অভিযোগ। ৬৬ বছরের দেবেন্দ্রনাথের দাবি, মিথ্যা মামলায় তাঁকে ছয় দিন জেল খাটানো হয়েছে। জলপাই পোশাকের কয়েকজন দীর্ঘদেহী এগিয়ে আসেন। কথা থামিয়ে আমাদের গাড়ি ছোটে ভাঙাবেড়া শহীদবেদির দিকে। কিছু শুকনো ফুল পড়ে আছে সাদা ফলকের নিচে। আর কিছুক্ষণ পরে চাঁদ উঠবে। ভোটের আগের রাতে জোৎস্নায় পরিষ্কার দেখা যাবে এলাকার সবচেয়ে উঁচু মিনার।