শান্তনু কর, জলপাইগুড়ি: এক বার বাঁশির শব্দ মানেই ওরা আসছে। দু’বার শব্দের অর্থ লাইন ক্লিয়ার। আর পরপর তিনবার বাঁশি বেজে উঠলেই একে একে ঢুকতে শুরু করবে ট্রাক ও ট্রাক্টর। রয়েছে ম্যাজিক বাঁশিও। যা পর পর কয়েকবার বাজলেই কর্পূরের মতো উড়ে যাবে বালি মাফিয়ারা। গত কয়েক বছর ধরে জলপাইগুড়িতে এভাবেই চলছে বালি পাচার।
জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের কোনপাকরির সরকার পাড়া হয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশে গিয়ে মিশেছে যমুনা নদী। একটা সময় স্নান, পান সবই চলত এই নদীর জলে। এখন নদীর কাছাকাছি যেতে ভয় পান স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, প্রতিদিন যমুনাকে খুবলে খাচ্ছে বালি মাফিয়ারা। ট্রাক, ট্রাক্টরে ভরে ভরে পাচার করে দিচ্ছে যমুনার বালি। যমুনা সেতুর পাশে বাড়ি শম্ভু রায়ের। নদীর পারে চার বিঘা চাষের জমি রয়েছে তাঁর। জানান, পদ্ধতি না মেনে বালি তোলার ফলে বর্ষায় ভয়ংকর হয়ে উঠছে যমুনা। গতি পথের ও পরিবর্তন শুরু হয়েছে। নদী তার জমির দিকে এগিয়ে আসায় ইতিমধ্যেই নদী গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে তার এক বিঘা চাষের জমি। শম্ভু রায় বলেন, “প্রতিবাদ করেছিলাম। জুটেছে গালিগালাজ আর হুমকি। ছেলে, বউ নিয়ে সংসার।” ভয়ে আর প্রতিবাদ করেননি তিনি। শম্ভুবাবুর মতো প্রতিবাদ করেছিলেন আরও কয়েকজন। কিন্তু এখন তারাও চুপ।
[আরও পড়ুন: ক্যানসার রোগীদের প্রতি সহমর্মিতা, বাড়ির আপত্তি উপেক্ষা করেই চুল দান কলেজ ছাত্রীর]
গ্রামবাসীরা জানান, একজন-দু’জন নয়। এক সঙ্গে অনেকে মিলে এই কারবার চালায়। সঙ্গে লাঠি-ধারালো অস্ত্র তো থাকেই। আগ্নেয়াস্ত্র থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য মাসুদা বেগম জানান, বালি চুরি বন্ধ করতে একাধিকবার পুলিশ, প্রশাসনকে জানিয়েছেন তিনি। তার আক্ষেপ পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন আসেন কিন্তু কাউকেই খুঁজে পান না। পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন এলে কর্পূরের মতো উড়ে যায় বালি মাফিয়ারা! কিন্তু কীভাবে? সেই ভ্যানিশ রহস্য ফাঁস করেছেন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা জানান, জলপাইগুড়ি থেকে কোনপাকরি বাজার হয়ে সরকার পাড়ার বাঁকে বাঁকে এদের ইনফর্মার রয়েছে। শনি, রবি সরকারি অফিস বন্ধ থাকে। তাই এই দু’দিন রাত সাড়ে নয় টা, বাকি সোম থেকে শুক্রবার রাত তিনটার পর ট্রাক, ট্রাক্টর সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ঢোকেন বালি মাফিয়ারা। ভোররাত পর্যন্ত চলে বালি তোলা। সেই বালি চলে যায় জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের হলদিবাড়ি-সহ বিভিন্ন এলাকায়।
বালি মাফিয়ারা গ্রামে ঢোকার আগে বিভিন্ন রাস্তার মোর থেকে শোনা যায় সাঙ্কেতিক বাঁশির শব্দ। গ্রামবাসীরা জানেন, বাঁশির প্রথম শব্দের পর কিছুক্ষন চুপচাপ। এরপর দু’বার বাঁশির শব্দ। তার ও কিছুক্ষণ পর তিনবার বাঁশি বাজলেই শুরু হবে আসা। আর বিপদ বুঝলে পর পর বাজতে থাকবে বাঁশি। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, ওটাই ভ্যানিশিং বাঁশি। যা বেজে উঠলেই মুহুর্তের মধ্যে খালি হয়ে যাবে এলাকা। তখন যমুনার বালি চোর ধরতে এসে হাত কামড়াতে হয় পুলিশ প্রশাসনের কর্মীদের। যদিও পুলিশ-প্রশাসনের দাবি হাল ছাড়েন নি তাঁরা। জলপাইগুড়ি সদর ভূমি ও রাজস্ব আধিকারিক তুহিন বিশ্বাস জানান, “অভিযান চলছে। বালি চুরি বন্ধ করতে প্রায় প্রতিদিনই ধরা হচ্ছে গাড়ি। কৌশল বদল করলেও পার পাবে না বালি চোরেরা।”