অর্ণব দাস, বারাকপুর: ব্যস্ততম সন্ধ্যা। জনবহুল এলাকায় এসে দাঁড়াল একটি বাইক। আরোহী তিনজন। তাদের একজন পকেট থেকে মোবাইল বার করে ছবি দেখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যক্তির সঙ্গে মিলিয়ে নিল। তার পর নাম জিজ্ঞাসা করেই পর পর চালানো গুলি। জগদ্দলের এই খুন যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে, সময় বদলেছে। সরকার বদলেছে। কিন্তু বারাকপুর রয়ে গিয়েছে বারাকপুরেই।
সম্প্রতি বারাকপুর লোকসভার অন্তর্গত আমডাঙা পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধানকে বোমা মেরে খুন করা হয়। চলতি মাসের শুরুতে টিটাগড়ের উড়নপাড়ায় দুষ্কৃতিদের গুলিতে মৃত্যু হয় একজনের। তার আগে টিটাগড়েই তৃণমলের দুই কাউন্সিলরের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল এক দলীয়কর্মীর। অক্টোবরের মাঝামাঝিতে পারিবারিক অশান্তির জেরে জামাইকে কুপিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠেছিল শ্যালকের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক অথবা দুই গোষ্ঠীর লড়াই কিংবা পারিবারিক বিবাদ, পরিণতি হিসাবে খুন করাটাই যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে গিয়েছে এই এলাকায়। ব্যঙ্গস্বরে এব্যাপারে বলতে গিয়ে ভাটপাড়ার একজন বললেন, এখনতো কিশোররাও শাসানি দিতে বলে, আমি ভাটপাড়া কিংবা টিটাগরের ছেলে!
[আরও পড়ুন: বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণীর দেহ উদ্ধারে এখনও রহস্যের জট, সাসপেন্ড ১২ নিরাপত্তারক্ষী]
এসবের মাঝে মূল প্ৰশ্নটা হল, কী কারণে বারাকপুর শিল্পাঞ্চল অপরাধ জগতের শিরোনামে? এর উত্তরে এক প্রশাসনিক কর্তা জানান, কমবেশি ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাবিশিষ্ট এই শিল্পাঞ্চলে বর্তমান জনসংখ্যা ৪০ লক্ষেরও বেশি। একসময় এই এলাকার অর্থনীতির কাণ্ডারী ছিল চটশিল্প। কিন্তু কয়েক দশকে এই শিল্পাঞ্চলে কমবেশি ৫৬টি বড় কারখানা বন্ধ হয়েছে। তারমধ্যে অনেক কারখানাই পুনরায় চালু করা সম্ভব নয়। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বিরাট সংখ্যায় শ্রমজীবী মানুষ। বিকল্প কর্ম সংস্থান তৈরি হয়নি এই এলাকায়। ফলে দিনদিন যেমন কারখানায় কর্মী বিচ্যুতির সংখ্যা বেড়েছে, তেমনই নতুন করে বেড়েছে বেকার যুবকের সংখ্যা। এদের অধিকাংশই সহজে অর্থ উপার্জনের লোভে পা বাড়িয়েছে অন্ধকার জগতের দিকে। এভাবেই ধীরে ধীরে রাজ্য ছাড়িয়ে বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের কুখ্যাতদের নাম প্রতিবেশী রাজ্য বিহার ঝাড়খন্ডে পৌঁছে গিয়েছে। অপরাধ করে জেলে গিয়েও অন্ধকার জগতের অনেকের সঙ্গে তাদের পরিচিতি হয়েছে। এইভাবেই ক্রাইম ওয়ার্ল্ডে তাদের একের পর এক নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। তাই অচেনা মুখ দিয়ে খুন করানোর জন্য টাকা দিয়ে বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে দুষ্কৃতি নিয়ে আসা এখন সহজ হয়ে গিয়েছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই তৃণমূল কর্মী ভিকি যাদবকে ভরসন্ধ্যায় জগদ্দল থানার অন্তর্গত ভাটপাড়া পুরসভার ১৭নম্বর ওয়ার্ডের পুরানি তালাব সংলগ্ন বাড়ির সামনে ভিন রাজ্যের ভরাটে খুনিদের দিয়ে খুন করানো হয়েছে বলেই পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
স্থানীয় রাজনীতি, বেকারত্ব, বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবের কারণেই দিনের পর দিন শিল্পাঞ্চলে অপরাধ বাড়ছে বলেই মনে করছে বিভিন্ন মহল। এ বিষয়ে বারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং বলেন, অপরাধে কী করে লাগাম টানতে হয়, তা আমি জানি। এই শিল্পাঞ্চলে হুকিং, জুয়া আর হেরোইন বন্ধ করতে হবে। এখান থেকে অপরাধীদের হাতে কাঁচা পয়সা আসে। অপরাধীদের এলাকার বাইরে, নাহলে জেলে রাখতে হবে। এই পদক্ষেপগুলি নেওয়া হলেই শিল্পাঞ্চলে অপরাধে লাগাম টানা যাবে। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ডানকুনি থেকে কল্যাণী পর্যন্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর তৈরি হলে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি হয়ে বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে অপরাধের স্থায়ী সমাধান মিলবে বলেও জানান তিনি।