সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মিউনিখ অলিম্পিক, ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর, মোসাদ, অপারেশন রাথ অফ গড। এই কয়েকটি শব্দেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের অন্যতম একটি রক্তাক্ত অধ্যায়। যুগে যুগে নিপীড়িত ইহুদি জাতির কান্না ও প্রতিহিংসার লড়াই। এই ক’টি শব্দই যেন আমূল পালটে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে। ইজরায়েল ও মোসাদ যেন শমন-সমার্থক হয়ে ওঠে প্যালেস্তিনীয় সন্ত্রাসবাদীদের কাছে। তবুও কেন গাজা থেকে ইজরায়েলি ভূখণ্ডে এহেন আত্মঘাতী হামলা চালাচ্ছে জেহাদি সংগঠন হামাস? কারা এই হামাস?
‘হরকত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া’ (হামাস)। বাংলা তর্জমায় এই নামের অর্থ ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন। গাজা থেকে কার্যকলাপ চালায় প্যালেস্টাইনের এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি। জন্ম ১৯৮৭ সালে। প্রথম ইন্তিফাদার সময়। শুরুর দিকে অহিংস আন্দোলনের কথা বললেও তা ক্রমে জেহাদের বিষ ছড়তে শুরু করে। হামাসের অতীত লুকিয়ে ১৯২০ সালে মিশরে তৈরি হওয়া সুন্নি জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডে। সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গাজায় নিজস্ব জমি তৈরি করে নেয় হামাস। ‘ইহুদি হানাদার’দের দেশ ইজরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে স্বাধীন প্যালেস্টাইন গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য।
কেন ইজরায়েলি ভূখণ্ডে এহেন আত্মঘাতী হামলা চালাচ্ছে জেহাদি সংগঠন হামাস?
(১) আরব-ইজরায়েল কূটনীতি: ইয়ম কিপুর যুদ্ধের কথা গোটা বিশ্ব জানে। কীভাবে মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বে ইজরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করতে হামলা চালিয়েছিল আরব দেশগুলি। তবে পরিস্থিতি পালটেছে।মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও জর্ডানের মতো মুসলিম দেশগুলি আর প্যালেস্টাইনের লড়াইয়ে নিজেদের স্বার্থ বলি দিতে রাজি নয়। লাগাতার লড়াই ও সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিলে বিশ্বমঞ্চে একঘরে হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া, শিয়া দেশ ইরানকে নজরে রেখে আমেরিকাকে চটাতে চায় না তারা। এই প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালে আমেরিকার পৌরোহিত্যে ইজরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে আব্রাহামিক অ্যাকর্ড হয়। কয়েক দশকের সংঘাতে ইতি টেনে মিশর ও জর্ডনের পর ইজরায়েলকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও বাহরিন। সেই সঙ্গে সৌদি আরবের কাছ থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি পেতে ওয়াশিংটন ও রিয়াধের সঙ্গে জটিল এক ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় ব্যস্ত রয়েছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। গত মাসে ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চলছে বলে প্রথমবার প্রকাশ্যে স্বীকার করেন সৌদি যুবরাজ মহম্মদ-বিন-সলমন। পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছিল তাতে ইজরায়েলকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সৌদির স্বীকৃতি সময়ের অপেক্ষা মাত্র। অতীতে সৌদি আরবের অবস্থান ছিল, প্যালেস্টাইনকে স্বাধীনতা দিলেই তারা ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে।
এই গোটা ঘটনাবলিতেই আপত্তি হামাসের। আরব-ইজরায়েল সংঘাত মিটে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের গোটা সমীকরণ পালটে যাবে। হামাসের রক্তক্ষয়ী জেহাদে সমর্থনে ভাটা পড়বে। শক্ত হবে ইজরায়েলের হাত। ফলে স্বাধীন প্যালেস্টাইন গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। তাই শনিবার গাজা থেকে হামলা চালিয়ে ইজরায়েলকে যুদ্ধ করতে একপ্রকার বাধ্য করেছে হামাস। মুখ পুড়েছে মোসাদের। ইজরায়েলী সেনার অপরাজেয় ছবি ধাক্কা খেয়েছে। হামাস জানত, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপে ও মুখরক্ষায় গাজায় আগুন ঝড়াবে ইজরায়েলী ফৌজ। এই পরিস্থিতিতে তেল আভিভের সঙ্গে সৌদি আরব ও অন্য মুসলিম দেশগুলো সম্পর্ক জোর ধাক্কা খাবে। প্যালেস্টাইন ইস্যুতে চুপ থেকে শিয়া ইরানকে সুবিধা করে দেবে না তারা। আর হয়েছেও তা। প্যালেস্টাইনকে মদত দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রিয়াধ। সব মিলিয়ে, গাজাকে ইজরায়েলের আফগানিস্তান করে তুলতে চাইছে হামাস।
(২) প্যালেস্টাইনের অন্দরে ক্ষমতার লড়াই: প্যালেস্টাইন আসলে কোনও রাষ্ট্র নয়। বলা যেতে পারে রাষ্ট্রের ধারণা মাত্র। ইজরায়েলি ভূখণ্ডের বুকে মূলত গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্যালেস্তীনিয়ের বাস। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের শাসনভার রয়েছে মাহমুদ আব্বাসের প্যালেস্তিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটির (পিএনএ) হাতে। ইজরায়েলের সঙ্গে মিলেমিশেই কাজ করে তারা। তবে গাজায় কিন্তু হামাসেরই রাজত্ব। প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে প্রেসিডেন্ট বলে স্বীকার করে না তারা। ২০০৭ সালে আব্বাসপন্থী ফতেহকে লড়াইয়ে হারিয়ে পঠিয়ে দেয় হামাস। তারপর থেকে গাজায় অবাধে কার্যকলাপ চালাচ্ছে ইসলামিক জেহাদ, হেজবোল্লাহর মতো জঙ্গি সংগঠন। তাই প্যালেস্তিনীয়দের কাছে নিজেদের আসল যোদ্ধা এবং রক্ষাকর্তা বলে তুলে ধরতেই শনিবার ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছে হামাস। কারণ, ইজরায়েল পালটা মার দেবে এটা তারা জানত। এর এমনটাই হয়েছে। ইজরায়েলি বোমায় বিধ্বস্ত গাজায় প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে আক্রোশ চরমে পৌঁছেছে। ফলে হামাসের প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি পাবে। ধাক্কা খাবে মাহমুদ আব্বাসের ছবি।
[আরও পড়ুন: কেন হামলার কথা জানতে পারল না ইজরায়েল, কেনই বা অন্ধকারে মোসাদ?]
উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সালের ৯ ডিসেম্বর শুরু হয় প্রথম ইন্তিফাদা। চলে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ১৯৮৭ সালে জন্ম নেয় হামাস। গাজায় এই আন্দোলন কিছুটা শান্তিপূর্ণ ভাবে শুরু হলেও রাশ চলে যায় আরব জঙ্গিদের হাতে যার ফলে নিশানা করা হয় নিরীহ ইজরায়েলি জনতাকে। পালটা দেয় তেল আভিভও। সেই সংঘাতে প্রাণ হারান হাজারেরও বেশি প্যালেস্টাইনের নাগরিক। মৃত্যু হয় দেড়শো ইজরায়েলির। ১৯৯৩ সালে আমেরিকার পৌরহিত্যে ওয়াশিংটনে ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইতঝাক রাবিন ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রধান ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ওসলো অ্যাকর্ড। তৈরি হয় প্যালেস্তিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি। এটাই মেনে নিতে পারেনি হামাাস। তাই ইজরেলের জনতার মধ্যে ভীতি জাগানো এবং বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠনের মধ্যে চলা এই আধিপত্যের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতেই হামাসের অভিযান বলে মনে করেন আমেরিকাস্থিত থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘Middle East Institute’-এর সিনিয়র ফেলো খালেদ আলদিনজি।
(৩) ইজরায়েলে অস্থিরতা ও বিক্ষোভ: ইজরায়েলের রাজনৈতিক ডামাডোল, একাধিক নির্বাচন, অস্থির সরকার ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতায় হস্তক্ষেপ করার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর চেষ্টার ফলে দেশে নজিরবিহীন বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন অনেক ইজরায়েলি। কিছুটা শিথিল হয়ে যায় মোসাদ ও সেনার নজরদারি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে হামাস।
অস্তিত্ব সংকটে হামাস?
শনিবার ইজরায়েলের বুকে যে হত্যালীলা চালিয়েছে হামাস তাতে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৮০০ ইজরায়েলি নাগরিক। বহু মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, ইজরায়েলি সেনার জওয়ান এবং অন্য দেশের নাগরিককে বন্দি করে গাজায় নিয়ে গিয়েছে তারা। এর ফল যে কী হতে চলেছে তা ভালোই জানে জঙ্গি সংগঠনটি। ইজরায়েল যে ভয়ানক হামলা করবে এবং হামাসের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে এটাও জানা ছিল। একপ্রকার বাঁচা মরার লড়াইয়ে নেমেছে হামাস। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, মূলত ইরানের মদতেই এতটা আক্রমণাত্মক হয়েছে তারা। হামাসের সেনাপ্রধান মহম্মদ দাইফ ও রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়েহ একাধিক বার নাকি তেহরান সফরেও গিয়েছেন। পড়শি লেবানন থেকে হেজবোল্লার মদতও রয়েছে। এছাড়া, গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও জেরুজালেমের আরব বাসিন্দারাও তাদের পাশে দাঁড়াবে বলে আশা করছে হামাস। সব মিলিয়ে গাজাকে ইজরায়েলের আফগানিস্তান করে তুলতে চাইছে হামাস।