অরিঞ্জয় বোস: মহাবিশ্বের এই মহাসংসারে এমনতর ঘটনা ঘটেনি কখনও। দেবীর আসনে যিনি উপবিষ্ট, আর সাধকের আসনে যিনি ধ্যানমগ্ন, তাঁরা ব্যক্তিগত সম্পর্কে পত্নী এবং পতি। এযাবৎ ভারতীয় সংস্কৃতি নারীকে দেবীজ্ঞানে সম্মান করার কথা বলেছে অনেক, বহু সাধকের সাধনপথের সঙ্গিনী হয়েছেন তাঁরা, তবু শক্তির হাতেই সাধনার সমস্ত ফল অর্পণ কে আর করেছিলেন! কে আর আরাধ্যার মধ্যে অন্তর্লীন করে তুলতে পারেন একত্র-ধর্মিণীকে। পেরেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। আর ভারতের ধর্মসাধনার ইতিহাসের এই প্রজ্জ্বল মুহূর্ত এসেছিল ফলহারিণী কালীপুজোর দিনে।
১৮৭২ সাল। জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথি। এই দিনই সারদা মা’কে ষোড়শীরূপে পুজো করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। এখনও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে এই পুজো ‘ষোড়শী’ পুজো নামে পরিচিত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই দিনেই তাঁর সমস্ত সাধনার ফল আর জপের মালা শ্রীসারদা দেবীকে অর্পণ করেছিলেন। দেবীরূপে পুজো করেছিলেন জগৎকল্যাণের জন্য।
[আরও পড়ুন: চোখ রাঙাচ্ছে মাঙ্কিপক্স, রাজ্যের হাসপাতালগুলিকে প্রস্তুতির পরামর্শ স্বাস্থ্যদপ্তরের]
ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও মা সারদার ভিতর ছিল এক অলৌকিক দাম্পত্য। সাধারণের নিক্তিতে তার অনুধাবন সম্ভব নয়। কেননা এমন দাম্পত্যের কোনও পূর্বাভাস ছিল না, সম্ভবত নেই কোনও উত্তরভাসও। স্বতন্ত্র এই দাম্পত্যকথার অন্তর্গত অলৌকিক বিভাটুকু আজও আমাদের আচ্ছন্ন করে। আর এই সম্পর্ক শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করল এক জৈষ্ঠ্যের অমাবস্যাতেই। সেখান থেকে একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যায়, এই বিবাহ যখন হয়েছিল, তখন সাধনপথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন ঠাকুর। সংশয়দীর্ণ মনকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশ ঈশ্বর অভিমুখী করে তুলেছিলেন। একদিন সেই ঠাকুরের সহধর্মিণী হলেন বালিকা সারদা, উচ্চারিত হল আত্মার বন্ধনস্বরূপ অমোঘ মন্ত্ররাজি- ‘মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু, মম চিত্তমনুচিত্তং তেহস্তু’। বালিকা সারদার মনে আধ্যাত্মিক ভাবধারার বিকাশ ঘটিয়ে এবং নিজের সাধনসঙ্গিনী হিসাবে সারদাকে গড়ে নিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। কারণ তিনি জানতেন সারদা কোনও সাধারণ মেয়ে নন। তিনিই ভবিষ্যতে তাঁর আদর্শ ও ভাবাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। যে রামকৃষ্ণ সংঘ পথ দেখাবে বিশ্বকে, তার চালিকাশক্তি হবেন সারদাই। তাই তাঁর হয়ে-ওঠারও এক পর্ব আছে। সে এক নিভৃত কঠিন সাধনা, দরজায় তার ঝোলানো দাম্পত্যের পর্দাটুকু। একেবারে গোড়ায় অবশ্য ঠাকুরের ভাবোন্মত্ত অবস্থা দেখে সারদা ভয় পেতেন। ধীরে ধীরে এই সম্পর্কের পরত খুলতে লাগল। ঠাকুর চিনলেন মা’কে। মা’ও চিনে নিলেন ঠাকুরকে। বুঝলেন, এ সম্পর্কের ভাবের ঘরে কোনও চুরি নেই।
১২৮০ বঙ্গাব্দের ১৩ জৈষ্ঠ্য। এল ফলহারিণী কালী পুজোর দিন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আঠেরো বছরের শ্রীমাকে সাক্ষাৎ ষোড়শী জ্ঞানে পুজো করলেন। মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে সমাধিমগ্ন হলেন ঠাকুর। বাহ্যজ্ঞান তিরোহিতা মা’ও তখন সমাধিস্থা। সাধক ও তাঁর আরাধ্যা দেবী আত্মস্বরূপে একীভূত হলেন। আধ্যাত্ম সাধনার আকাশে সেক্ষণে নিশ্চয়ই বেজে উঠেছিল অলৌকিক শঙ্খ। সংবিৎ ফিরলে ঠাকুর প্রণাম করলেন মা’কে। অর্পণ করলেন নিজের সারা জীবনের সাধনার ফল এবং জপের মালা।
পৃথিবীর আধ্যাত্মিক ইতিহাসে এ এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জগতের ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনা যেমন তুলনাবিহীন তেমনি আপামর পৃথিবীবাসীর কাছে দাম্পত্যের এক যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরলেন তিনি। গৃহে ও সমাজে রমণীদের স্থান কোথায় এবং তাদের প্রকৃত স্বরূপ কী- তা চেনালেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এত বড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন এবং সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থানে গভীর রেখাপাত করে, তা ঘটেছিল নিভৃতে, অনাড়ম্বরভাবে। সেই পুজোয় পূজ্যা ও পূজক ছাড়া আর কারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না। পরবর্তী কালে স্বামী সারদানন্দ রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ এবং ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য রচিত ‘শ্রীশ্রী সারদাদেবী’ গ্রন্থে ষোড়শী পুজোর বিবরণ পাওয়া যায়। জগৎ যেন জানতে পারল, এক বিপ্লবের জন্মকথা। এযাবৎ অবতারপুরুষগণ – বুদ্ধ, চৈতন্য প্রমুখ স্ত্রীকে ত্যাগ করেই এগিয়েছিলেন সাধনপথে। রামকৃষ্ণ যেন আক্ষরিক অর্থে বোঝালেন সহধর্মিণী শব্দের অর্থ। সেই সামাজিক প্রেক্ষিতে নারীর যে অবস্থান ছিল, আর নারীর যে অবস্থান হওয়া উচিত – তা-ই যেন দেখিয়ে দিলেন ঠাকুর, যা উত্তরকালে নারীমুক্তির নান্দীমুখ হয়ে থাকবে।
[আরও পড়ুন: কীভাবে আয়োজিত হবে পুরীর রথযাত্রা? জানাল প্রশাসন]
আর ঠিক এখানেই আমরা যেমন প্রণত ঠাকুরের কাছে, তেমন মায়ের কাছেও। উপযুক্ত আধার না হলে ঠাকুরের মতো সাধকের পুজো তিনি গ্রহণ করতে পারতেন না। পরে তাই মাকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, ঠাকুর ভগবান হলে আপনি কে? মা বলেছিলেন, আমি আর কে, আমি ভগবতী।
ভগবান ও ভগবতীর এই অপূর্ব আত্মিক মিলনেই মহিমাময় ফলহারিণী কালীপুজোর মুহূর্ত।