shono
Advertisement

‘সমাজ কি আমার এই অপরাধ মেনে নেবে না?’ কেন একথা মাধবীকে বলেন সত্যজিৎ রায়?

কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা কথায় অভিনেত্রী।
Posted: 01:42 PM Aug 28, 2023Updated: 01:45 PM Aug 28, 2023

সত‌্যজিৎ রায়ের (Satyajit Rai) সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা মাধবী মুখোপাধ‌্যায় (Madhabi Mukherjee)। সেই প্রথম। ১৯৯২ সালে ঝড় তোলা সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’ পত্রিকার সাংবাদিক এস এন এম আবদি। বিতর্কের সুনামি উঠেছিল। এখন অনুবাদ করলেন শীর্ষেন্দু চক্রবর্তী। আজ তৃতীয় কিস্তি।

Advertisement

আপনার কী মনে হয়, সত্যজিতের থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে ফেলে পেশাগত ভাবে আপনি ভুল করেছিলেন?
দু’টো জিনিস মিশিয়ে ফেলা একেবারেই পছন্দ করি না। আমি তো চায়ের সঙ্গে কফি মিশিয়ে খাই না। আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ না-ও হতে পারি, কিন্তু আমারও কিছু নীতি আছে। মাধবী সিনেমার জন্য সম্পর্কে জড়িয়েছিল, এটা কেউ বললে মেনে নিতে পারব না। আমার কাছে ভালবাসা আর পেশা সম্পূর্ণ আলাদা দু’টো বিষয়। আমার ফিল্ম যদি দর্শকের পছন্দ না হয়, তাতেও আমার কোনও আফসোস থাকবে না। কিন্তু আমি যদি কাউকে ভালবাসি, তা হলে তাকে শুধু ভালই বাসব। তাতে কোনও শর্ত থাকবে না। ভালবাসার সঙ্গে কোনও কিছু মেশাতে পারব না। আর এই কারণে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের ভালবাসা অটুট ছিল।

‘ভালবাসা অটুট ছিল’ বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
আমি যে মানুষটাকে ভালবাসতাম, সেই মানুষটিও আমায় ভালবাসতেন। এতে কোনও সন্দেহ ছিল না। আমাদের কারও মধ্যে কোনও প্রত্যাশা ছিল না। তার কোনও প্রয়োজনও ছিল না। যাঁকে আপনি ভালবাসেন, যাঁকে আপনি শ্রদ্ধা করেন, তাঁকে দখল করার মানসিকতা রাখা উচিত নয়।

কখনও মনে হয়নি, সম্পর্কটা আবার শুরু করি?
আমি যে মানুষটাকে ভালবাসতাম তিনি বিবাহিত ছিলেন। এক জন মহিলা হয়ে অন্য এক জন মহিলার ক্ষতি করার কথা আমি ভাবতেও পারতাম না। তবে আজ আপনাকে একটা কথা আমি জানাতে চাই। এমন একটি সত্য যা আমি আমার আত্মজীবনীতে (যদি আদৌ কোনও দিন লিখি) লিখতে চাই। আমি এক বার আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, এ ছাড়া আমার সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা নেই। আমি ৬০টি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম। আমায় মেডিক্যাল কলেজে ভরতি করানো হয়েছিল। হাসপাতালে আমি চার দিন অচৈতন্য ছিলাম। অবশেষে আমার পেট থেকে যাবতীয় বিষ বার করতে সক্ষম হন চিকিৎসকেরা। বিষয়টা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এই ঘটনা আমার বিয়ের অনেক আগে, ১৯৬৮ সালে।

আপনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন কেন?
আসলে আমি কোনও দিন কারও ক্ষতি করতে চাইনি। বিশেষ করে সেই মানুষটার, যাঁকে আমি এত ভালবাসতাম। তাই যখন তাঁর নাম আমার নামের সঙ্গে যোগ করে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছিল, আমার মনে হয়েছিল, নিজেকে শেষ করে ফেলাই সহজতম উপায়। আমাদের সমাজ এই ধরনের সম্পর্ককে কখনও মেনে নেয়নি।

কোনও দিন কি সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন যে তিনি আপনাকে ভালবাসেন?
তিনি একটা কথাই বলতেন, ‘আমি জীবনে এত কিছু অর্জন করেছি, এত সম্মান পেয়েছি। সমাজ কি আমার একটা ছোট্ট অপরাধ মেনে নেবে না?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘না। এ সমাজ আপনার উচ্চতায় পৌঁছতে পারেনি। তাই এই সম্পর্ক কখনওই মেনে নেবে না।’

‘অপরাধ’ বলতে সত্যজিৎ কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? তিনি কি আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন?
এখন আর এই প্রশ্নের কোনও অর্থ হয় না। তখন অবিবাহিতা ছিলাম। ফলে আমার বিয়েতে অ-রাজি হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু যাঁকে ভালবাসতাম তিনি বিবাহিত ছিলেন, তাঁর একটি সন্তান ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হল, ওঁর স্ত্রী আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেছিলেন।

কিন্তু ‘অপরাধ’ বলতে সত্যজিৎ কী বলতে চেয়েছিলেন?
তিনি আমায় ভালবাসতেন। আর সেটাই ছিল ওঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। সমাজের চোখে আমাদের সম্পর্ক অবৈধ ছিল। আমার মনে হয়, আমি যদি তখন বলতাম যে এটা কোনও অপরাধ নয়, তা হলে সমস্যা কম হত। ‘আগন্তুক’ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আমায় বিশেষ শোয়ে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আরও জানিয়েছিলেন, ‘চারুলতা’র পর তাঁর সেরা ছবি ‘আগন্তুক’। আমি তাঁকে আমার শুটিংয়ের ব্যস্ততার কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু, আমায় আসার জন্য জোর করেছিলেন। শোয়ে আমি আবিষ্কার করলাম যে, তিনি কতটা আত্মবিশ্বাস হারিয়েছেন। বুঝতেই পারছিলাম, তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। এরপর তাঁকে নার্সিং হোমে দেখতে গিয়েছিলাম। তার পর উনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

[আরও পড়ুন: ‘পাঠান’-এর শাপমোচন! এবার ভারত-বাংলাদেশে একইদিনে মুক্তি পাচ্ছে শাহরুখের ‘জওয়ান’]

ছয়ের দশকে যখন আপনাদের প্রেম কাহিনি আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, সেই সময় আপনি সম্পর্ক শেষ করলেন কী ভাবে?
আমার অন্তরাত্মা আমায় আটকেছিল। আমি তাঁকে ঠিক সেই কথাই বলেছিলাম যা পরবর্তীকালে আমার স্বামীকে বলেছিলাম। সব কিছুরই একটা শেষ আছে। ফেরার আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। আমরা শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে পারি। আমার স্বামীও আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত বদলাইনি। এক জন নারী যে তার সমস্ত দুঃখ, সমস্ত কষ্ট নিয়ে একা থাকতে পারে, আমি তার একটা উদাহরণ তৈরি করতে চেয়েছিলাম।

আপনার কি কখনও মনে হয়নি যে আপনার গর্ভে সত্যজিতের সন্তান জন্ম নিক?
না। কেন তা মনে হবে? আমি রবীন্দ্রনাথের শিষ্যা। আমার শিক্ষা বলে, ভালবাসা এমনই একটা জিনিস যার জন্য সবসময়ই একটা দূরত্বের প্রয়োজন। আমি কাউকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেই পারি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি আমার সম্পত্তি।

এক জন প্রবাদপ্রতিমের সঙ্গে সম্পর্কের পর আপনার জীবনে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের কি আপনার অত্যন্ত সাধারণ বলে মনে হয়নি?
আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ তিনিই। বাকিদের সঙ্গে ওঁর কোনও তুলনাই চলে না।

পুরুষ চরিত্রের দু’টি দিক থাকে—- একটি শারীরিক, অন্যটি মানসিক…
সত্যজিৎবাবুই একমাত্র যাঁর হাত আমি সারা জীবন ধরতে চেয়েছি।

কিন্তু আপনি তো ১৯৬৮ সালে আপনার স্বামীর হাত ধরেছিলেন?
সেটা একেবারেই অন্য গল্প। সত্যজিৎবাবু ছাড়া আমি জীবনে যখনই অন্য কারও হাত ধরেছি, তা ধরেছি তাঁদের সাহায্য করার জন্য।

আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?
আমি বলতে চাইছি যে, তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। এই শব্দবন্ধ আমি ঈশ্বরের জন্যও ব্যবহার করি।

আপনার সঙ্গে কি সত্যজিৎ রায়ের শরীরিক সম্পর্ক ছিল?
শারীরিক সম্পর্ক স্থিতিশীল হয় না।

কিন্তু ছয়ের দশকে আপনাদের দু’জনেরই বয়স কম ছিল। আপনাদের সামনে কোনও বাধাও ছিল না।
আমি খুবই শীতল প্রকৃতির মহিলা। আমায় সারা দিন খেতে না দিয়ে যদি খুব ভাল গান শোনান, তাতেই খুশি থাকব।

কিন্তু পুরুষরা তো আলাদা।
সব পুরুষ সমান হন না। আর এই বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।

আপনি কি সত্যজিতের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কথা আপনার স্বামীকে জানিয়েছিলেন?
অবশ্যই। তাঁর কাছে কিছুই লুকোইনি। একেবারে নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিলাম। নতুন করে ভালবাসা আর সুখ খুঁজছিলাম। কিন্তু তা হওয়ার ছিল না। আমার স্বামী আমার সঙ্গে সেই ভাষায় কথা বলতেন, যে জঘন্য ভাষায় আমার কাজের লোককে তাঁর স্বামী বেইজ্জত করত। আমার স্বামীকে আমার মেয়েদের এ কথাও বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা কি জানো তোমাদের মায়ের প্রেমিকের নাম কী?’

সত্যজিতের মৃত্যুর পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
আমার মনে হয়েছিল একটা যুগের অবসান হল। আমাদের সবারই একই রকম মনে হয়েছিল।

কিন্তু আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল? তিনি তো আপনার প্রেমিক ছিলেন…
আমার মনে হয়েছিল যে তাঁর সঙ্গে অন্যায় হয়েছে।

সত্যজিতের সঙ্গে অন্যায়?
হ্যাঁ। আমার মনে হয় তিনি আশা করেননি যে আমি তাঁর সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক রাখব না। হয়তো আমার তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা উচিত ছিল। কিছু ভাল কথা, সমবেদনা, কারও ক্ষতি করে না। কিন্তু, সেই কথাগুলিই এক জন মরণাপন্ন মানুষকে আবার বেঁচে ওঠার শক্তি জোগায়। এই জন্যই মনে হয়েছিল যে, আমি তাঁর প্রতি অন্যায় করেছিলাম। আমার মনে হয়, তিনি মারা গিয়েছিলেন কারণ তিনি আর বেঁচে থাকতেই চাননি। আমার উচিত ছিল সবার জন্য তাঁকে বেঁচে থাকার অনুরোধ করা।

[আরও পড়ুন: জাতীয় পুরস্কার জিতেও ক্ষুব্ধ বাঙালি পরিচালক! ‘সর্দার উধম’ নিয়ে কী বললেন সুজিত সরকার? ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement