লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
ভারতীয় রাজনীতিতে কুরসির কিসসা শোনাতে বসলে গান্ধী পরিবারকে বাদ দিলে আলোচনা দানাই বাঁধবে না। এবং সেক্ষেত্রে ইন্দিরা-রাজীব বা সঞ্জয় কিংবা রাহুলদের প্রসঙ্গের সমান্তরালে অবধারিত ভাবেই থাকবেন 'ম্যাডাম'। আজ থেকে ঠিক দুই দশক আগে গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল একটাই প্রশ্নে। 'টু বি অর নট টু বি'? শেক্সপিয়রের সেই অমোঘ প্রশ্নচিহ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল সোনিয়া গান্ধীকে ঘিরে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি সরে দাঁড়ালেন। মনমোহন সিং হয়ে গেলেন 'অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার'। কেন প্রধানমন্ত্রীর কুরসি নিশ্চিত ভাবে আয়ত্তে পেয়েও সেদিন মনমোহনকে তা দিয়ে দিয়েছিলেন রাজীব জায়া? এই নিয়ে আলোচনা আজও জীবন্ত। ভারতীয় রাজনীতির অন্দরে কান পাতলে তা গমগম করে বেজে উঠতে থাকে।
ইটালির রোমান ক্যাথলিক পরিবারের সদস্য ২১ বছরের তরুণী সোনিয়া মাইনো ভারতের মাটিতে প্রথম পা রাখেন ১৯৬৮ সালে। স্বামী রাজীব গান্ধীর (Rajiv Gandhi) সঙ্গে। কেমব্রিজে ভাষাশিক্ষার ক্লাসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ সোনিয়ার। সেখান থেকেই প্রেম ও বিয়ে। গত শতকের ছয়ের দশকের শেষ ভাগে ভারতের মাটিতে পা রাখা তরুণীর শাশুড়ি ততদিনে দেশের মসনদে। ১ সফদরজং রোড তখন দেশের রাজনীতির নিউক্লিয়াস। ইন্দিরার পুত্রবধূ কি ক্ষুণাক্ষরেও জানতেন, ধীরে ধীরে রাজনীতির অলিন্দে পা রাখবেন তিনিও? ক্রমে হয়ে উঠবেন প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার? সত্যিই ভারতীয় রাজনীতির 'ম্যাডামে'র জীবনে 'নাটকীয়' উপাদানের কোনও অভাব নেই।
সোনিয়া গান্ধী। ফাইল ছবি।
[আরও পড়ুন: ‘শাহেনশা’ বাবু সেজে থাকেন অথচ ‘শাহজাদা’ বলেন আমার ভাইকে: মোদিকে কটাক্ষ প্রিয়াঙ্কার]
সোনিয়া ও রাজীব কিন্তু রাজনীতির ধারেপাশেও ছিলেন না। আটের দশকে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল সঞ্জয় গান্ধীর। রাজনীতির আঙিনায় মাকে সঙ্গ দিতে ১৯৮২ সালে রাজনীতির জগতে পা রাখলেন রাজীব। সোনিয়া কিন্তু ছিলেন পরিবার নিয়েই। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক তখনও তৈরি হয়নি। এদিকে চার বছর যেতে না যেতেই দেহরক্ষীর ১৬টি বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে গেলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi)। দেশের কুরসিতে বসলেন রাজীব। সোনিয়া (Sonia Gandhi) একেবারেই যা চাননি। যে আশঙ্কায় রাজীবকে মসনদে দেখতে চাননি তিনি, সেটাই সত্যি হয় ১৯৯১ সালে। শ্রীপেরুম্বুদুরে আত্মঘাতী হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রাজীবের দেহ। এমন ভয়ংকর মৃত্যুতে শিউরে উঠল দেশ। সোনিয়া তখন ৪৪। সে এক টালমাটাল সময়। দেশের রাজনীতি বিশেষ করে কংগ্রেসের অন্দরে। চিরকালই কংগ্রেস ও গান্ধী পদবি প্রায় হাত ধরাধরি করেই চলেছে। কিন্তু রাজীবের মৃত্যু যেন ইঙ্গিত করছিল, এবার কোনও গান্ধীকে ছাড়াই এগোতে হবে কংগ্রেসকে (Congress)। এই পরিস্থিতিতেই উঠতে শুরু করল সোনিয়ার নাম। আবার প্রশ্নও উঠতে লাগল, কয়েক বছর আগে যিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়েছেন তিনি কী করে দল সামলাবেন।
[আরও পড়ুন: শরীরে লুকনো ২৫ কেজি সোনা! মুম্বই বিমানবন্দরে আটক আফগান রাষ্ট্রদূত]
এই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি যিনি তুলেছিলেন তিনি শরদ পওয়ার। বলা হয়, সেই সময় থেকেই তাঁর দেশের মসনদে বসার স্বপ্নের শুরুয়াৎ। শিবিরে শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছিল হাত শিবির। ততদিনে রাজনীতিতে পা রাখার প্রস্তাবে 'না' করে দিয়েছেন সোনিয়া। পরবর্তী সময়ে এই নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, রাজীবের মৃত্যুর 'ট্রমা' তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছেন তাঁকে। তাছাড়া রাজনীতিতে কখনওই নিজের 'চায়ের কাপ' ভাবেননি তিনি। ফলত নিজেকে সেসব থেকে দূরে সরিয়ে নেন।
অথচ সেই সোনিয়াই ১৯৯৭ সালে কলকাতায় প্লেনারি সেশনে দলের সদস্যপদ গ্রহণ করলেন। ক্রমে খুব দ্রুতই হয়ে উঠলেন দলের সর্বভারতীয় এক মুখ। কিন্তু কেন আচমকাই বছর ছয়েকের মধ্যে তাঁর মতবদল? আসলে ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে হেরে গিয়েছিল কংগ্রেস। যে ভাঙনের চিহ্ন আগে থেকে লক্ষ করা যাচ্ছিল, সেই ভাঙন এবার আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। মাধবরাও সিন্ধিয়া, অর্জুন সিং, চিদাম্বরম, রাজেশ পাইলটের মতো নেতারা সভাপতি সীতারাম কেশরীর বিরুদ্ধে কার্যতই বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। অনেকে দল ছেড়ে চলেও গেলেন। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময় কংগ্রেসের প্রয়োজন ছিল এমন এক মুখ, যাঁর নেতৃত্বে ফের একজোট হতে পারে দল। সোনিয়া ছাড়া যোগ্য কেউ সেই সময়ে সত্যিই ছিলেন না। প্রণব মুখোপাধ্যায় বা অন্য সিনিয়র নেতারা থাকলেও একজন গান্ধীকেই বুঝি দরকার ছিল। সোনিয়াও সেটা বুঝেছিলেন। আর বুঝেছিলেন বলেই রাজনীতিতে পা রাখতে মনস্থির করে ফেলেছিলেন।
সেই শুরু। অল্প সময়েই কংগ্রেস নেত্রী হিসেবে নিজের স্থান পোক্ত করে ফেলতে থাকেন তিনি। হয়ে ওঠেন অপরিহার্য। দলীয় সদস্য হওয়ার ৬২ দিনের মাথায় তাঁকে কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি তা গ্রহণও করেন। ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জিতে সংসদে বিরোধী নেত্রী হলেন। এর পর ২০০০ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে জিতেন্দ্র প্রসাদকে ৯৭ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে হারান। যা বুঝিয়ে দেয় দলের ভিতরে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তখন কতখানি। ২০০৩ সালে বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা সোনিয়াই তখন বিরোধী নেতৃত্বের মুখ। পরের বছর ২০০৪ সালে 'ফেভারিট' বিজেপিকে উড়িয়ে দিল কংগ্রেস। সেই জয়ের পিছনেও আসলে সোনিয়ার কূটনৈতিক কৌশলই।
অথচ প্রতিরোধ তাঁকে কম সইতে হয়নি। বার বার তাঁকে 'বিদেশি' বলে তোপ দাগছিল বিজেপি। উমা ভারতী প্রশ্ন তোলেন, কেন সোনিয়া এদেশে আসার প্রায় পনেরো বছর পর দেশের নাগরিকত্ব নেন। অন্যদিকে সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ''ওঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়ার অর্থই হল ভারতমাতার ১০০ কোটির সন্তানের মধ্যে এমন কেউ নেই, যিনি দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।'' সেই সুষমাকে ১৯৯৯ সালে প্রায় ৫৬ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন সোনিয়া। এই পরাজয় মেনে নিতে পারেননি বিজেপি নেত্রী। ২০০৪ সালে যখন সোনিয়াই প্রধানমন্ত্রিত্বের কুরসির সবচেয়ে কাছাকাছি, সুষমা জানান, তিনি এটা কিছুতেই হতে দেবেন না। চুল কেটে শ্বেতবস্ত্র ধারণ করবেন। মাটিতে শোবেন। সামান্য খাদ্য গ্রহণ করবেন। আর এসবই করবেন প্রতিবাদ স্বরূপ। এমনকী সংসদেও যাবেন না। কেননা সোনিয়াকে 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী' বলে সম্বোধন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বাকি বিজেপি নেতানেত্রীদের বড় অংশই এভাবেই সরব ছিলেন।
সোনিয়া গান্ধীর কাছে অবশ্য এমন খোঁচা নতুন নয়। কেননা দলের মধ্যেই তো এমন অভিযোগ শুনতে হয়েছিল তাঁকে। শরদ পওয়ার প্রশ্ন তুলেছিলেন, যদি সত্যিই এই দেশকে নিজের দেশ বলে ভেবে থাকেন সোনিয়া, তাহলে তিরিশ বছর এখানে থেকেও কেন এদেশের কোনও ভাষাই শিখতে পারলেন না! আসলে প্রধানমন্ত্রিত্বের খোয়াব দেখতে দেখতে ততদিনে ধৈর্য আর অবশিষ্ট ছিল না পওয়ারের। তাই একেবারে গেরুয়া শিবিরের 'মুখপাত্র' হয়ে এমন আক্রমণ! যে করে হোক সোনিয়াকে কুরসির লড়াই থেকে সরাতে তখন তিমি মরিয়া। অথচ সোনিয়া ততদিনে দলের জাতীয় সভাপতি। দ্রুত ইস্তফা দেন তিনি। ভাবলে অবাক লাগে সবে রাজনীতির ময়দানে পা রেখে এমন 'মাস্টারস্ট্রোক' তিনি নিলেন কী করে? আসলে শাশুড়ি ও স্বামীর কাছ থেকে রাজনীতির যে পাঠ বছরের পর বছর ধরে সচেতন বা অবচেতনে তিনি নিয়েছিলেন সেটাই তাঁকে পোক্ত করে তুলেছিল রাজনীতির মঞ্চে। তাঁর এমন সিদ্ধান্তে নিশ্চিত হয়ে যায় শরদ পওয়ারের মতো নেতাদের নিষ্ক্রমণের দিকটি। কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটি পওয়ার, পি এ সাংমা ও তারিক আনোয়ারকে ৬ বছরের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করার পর নিজের ইস্তফা ফিরিয়ে নেন সোনিয়া।
ফলে ২০০৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে সবার দৌড়ে থাকার সময় বিজেপির ওই কটাক্ষ ও প্রতিবাদ সোনিয়ার কাছে খুব একটা অনভিপ্রেত ছিল না। তিনি জানতেনও এটাই গেরুয়া শিবির তথা বিরোধীদের মূল হাতিয়ার হয়ে ওঠার কথা। এই পরিস্থিতিতে কিন্তু খোদ সোনিয়ার কোনও মন্তব্য শোনা যায়নি তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। সাসপেন্স বাড়ছিল। ১৭ মে জানা গেল সোনিয়া তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের কাছে সরকার গড়ার প্রস্তাব দেবেন। এবার পরিষ্কার হয়ে গেল, সোনিয়ার নেতৃত্বেই সরকার গঠিত হবে। কিন্তু ১৮ মে সংসদের সেন্ট্রাল হলে সোনিয়া জানিয়ে দিলেন, তাঁর লক্ষ্য কোনওদিনই প্রধানমন্ত্রিত্বের আসন নয়। ''আজ আমার অন্তরাত্মা আমাকে বলছে, আমি যেন বিনম্র ভাবে এই পদটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করি।'' একথা সোনিয়া উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা হল জুড়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। কেবল ভিতরেই নয়, বাইরেও। এমনকী গাড়ির মাথায় চড়ে হাতে বন্দুক নিয়ে আত্মহত্যার হুমকিও দিতে লাগলেন কোনও কোনও কংগ্রেস সমর্থক। কিন্তু সোনিয়া নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন।
কিন্তু কেন? কেন মনমোহন সিংকে নিজের হাতে এসে যাওয়া কুরসিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন? আসলে 'ম্যাডাম' জানতেন তিনি মসনদ ত্যাগ করলে বিজেপির 'বিদেশি' খোঁচা চিরকালের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দলের ভিতরেও ভবিষ্যতের কোনও পওয়ার এমন বিরোধিতা করতে পারবেন না। ফলে তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠবেন অনতিক্রম্য 'পাওয়ার হাউস'। আবার যেহেতু সরকারের অংশ নন, তাই কোনও সরকারি সিদ্ধান্তে তাঁকে কাঠগড়ায় তোলাও সম্ভব হবে না। আর একটা কথাও শোনা যায়। পুত্র রাহুলের আপত্তিও মাথায় ছিল সোনিয়ার। যদিও এর পরও বিরোধীরা বলতে থাকেন, মনমোহন স্রেফ 'ছায়া'। ১০ জনপথের বাসিন্দা সোনিয়াই 'সুপার পিএম'। তবে সেই বিরোধিতা তেমন পোক্ত ছিল না। থাকলে ২০০৯ সালে আবারও ক্ষমতায় কি ফিরতে পারত কংগ্রেস?