shono
Advertisement
Bangladesh

ভারত কেন ‘চোখের বালি’

Published By: Kishore GhoshPosted: 08:42 PM Aug 14, 2024Updated: 08:42 PM Aug 14, 2024

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ভয়াবহ দুর্নীতির বহর সহ্যের সীমা পেরিয়ে জন্ম দিল আন্দোলনের। এই পালাবদলে ভারত যথেষ্ট সতর্ক ও উদ্বিগ্ন। হাসিনার এই অধঃপতনের দায় এ-দেশের পক্ষেও এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। কারণ, গত ১৫ বছর ধরে ‘বিশ্বস্ত প্রতিবেশী’ ও ‘পরম বন্ধু’ ভারত-ই তো তাঁর সবচেয়ে বড় খুঁটি। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। 

Advertisement

এখন মোটামুটি সবাই বুঝতে পেরেছে শেখ হাসিনাকে কেন এভাবে সব ছেড়েছুড়ে দেশত্যাগী হতে হল। কী-কী অপরাধ তিনি করেছেন যার দরুন তঁাকে এই শাস্তি পেতে হল। এক-দুই করে তা লিখতে গেলে, প্রথম কারণ হবে– চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য। অনেক দিন ধরেই কারও কোনও পরামর্শ তিনি শুনতেন না।

নিজের ইচ্ছামতো চলতেন। দ্বিতীয় কারণ, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকগুলো গেঁথে দেওয়া, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অন্ধ অনুগত আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করা। তৃতীয়, বিচারবিভাগকে নিজের ও দলের সুবিধামতো চালনা করা। চতুর্থ, আইনের শাসনের অবলুপ্তি ঘটানো। পঞ্চম, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি রোধে চরম ব্যর্থতা,
যার দরুন সর্বত্র হাহাকার সৃষ্টি হওয়া। এবং ষষ্ঠ– দুর্নীতি।

শেষের এই কারণ, মানে, দুর্নীতির বহর বাংলাদেশে ভয়ংকর। মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। ছোটবেলায় ‘পুকুর চুরি’-র অর্থ জেনেছিলাম। ১২ বছর ধরে বাংলাদেশে যাওয়ার সুবাদে দেখছি, পুকুর চুরি করা সে-দেশে কোনও অপরাধই নয়। তা ছিঁচকে চোরের কাজ। সমাজের মাথা যারা, সেসব রাঘব বোয়াল খালবিল, নদী, সাগর, পাহাড়, জঙ্গল সব হাপিশ করে দিচ্ছে! এক-একজনের চুরির বহর হাজার-হাজার কোটি টাকা। চুরির টাকার বেশিটাই বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে। বছর দুয়েক আগে সে-দেশের অর্থমন্ত্রীকে সংসদে বলতে শোনা গিয়েছিল, অর্থ পাচার কী করে রোখা যায়, কী করে বিদেশে গচ্ছিত টাকা দেশে ফেরানো যায়, তা তঁার জানা নেই। তিনি সদস্যদের পরামর্শ দিতে বলেছিলেন।

 

[আরও পড়ুন: ‘অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে!’ আর জি কর কাণ্ডে বিস্ফোরক বিজেপি]

সহ্যের সীমা না-পেরলে বিপ্লব হয় না। শেখ হাসিনার উপর আপামর বাংলাদেশি কতটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে, এই বিপ্লব তার প্রমাণ। এ থেকে আমাদের দেশেরও অনেক কিছু শেখার আছে। ১৫ বছর ধরে ভারত-ই তো হাসিনার সবচেয়ে বড় খুঁটি।
সত্যি হল, একদা জনপ্রিয় ও দেশবাসীর ‘চোখের মণি’ শেখ হাসিনা কোনও এক গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে রাতারাতি ‘চোখের বালি’ হয়ে যাননি। তঁার এই বিবর্তন ঘটেছে ধীরে-ধীরে। এখন যে-বিশেষণে তিনি ভূষিত, প্রবল সমালোচিত ও জনগণের একাংশের কাছে ঘৃণিত, সেই ‘স্বৈরতন্ত্রী’ তকমা পাওয়ার পিছনে ভারতের অবদান কম নয়।

একের-পর-এক নির্বাচনকে তিনি প্রহসনে পরিণত করেছেন। ভূ-রাজনৈতিক কারণে ভারত নীরবই শুধু থাকেনি, সমর্থনের ডালি নিয়ে দৃঢ়ভাবে পাশে দঁাড়িয়েছে। প্রধানত এই কারণে গণতন্ত্র-প্রিয় বাংলাদেশের এক বিরাট অংশের কাছে ভারত অ-জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর ‘বন্ধু’ থেকে ‘শত্রু’-তে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। গণতন্ত্রী হাসিনার অধঃপতনের দায় গণতন্ত্রী ভারত এড়াতে পারে না।

ভারতের উপর রাগের আরও অনেক কারণ আছে। গত ১২ বছরে বহুবার বহুভাবে সেসব কারণের উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের স্পর্শকাতরতার প্রতি আন্তরিক হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। দুই দেশের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি যাদের জানা, তারা জানে, খালেদা জিয়ার আমলে বাংলাদেশে সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দ ছিল ‘ট্রানজিট’। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারত সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহণের আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু খালেদা সরকার
রাজি হয়নি। হাসিনার রাজত্ব শুরু হওয়ার পর ‘ট্রানজিট’ শব্দটির জায়গা নেয় ‘কানেক্টিভিটি’। ধীরে ধীরে জল, স্থল,
রেল, অন্তরিক্ষ সর্বত্র যোগাযোগ বেড়েছে। মানুষজনকে সেজন্য বিক্ষোভে ফেটে পড়তে দেখা যায়নি। কারণ তারা বুঝেছিল, এতে তাদেরও লাভ।

কিন্তু সেই সমর্থন অসন্তোষও সৃষ্টি করেছিল। পণ্য পরিবহণের ‘ট্রানজিট ফি’ কত হওয়া উচিত, তা নির্ধারণে হাসিনা এক কমিটি গঠন করেন। কমিটি টন প্রতি ১ হাজার ৫২ টাকা ফি আদায়ের সুপারিশ করেছিল। অথচ, শেষ পর্যন্ত অঙ্কটা দঁাড়িয়েছিল ২০০ টাকারও কম। ব্যাপক প্রচার চলেছিল, ভারতের চাপের মুখে হামাগুড়ি দিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ভারতের বিরুদ্ধে ‘দাদাগিরি’-র অভিযোগ সেই শুরু।

 

[আরও পড়ুন: রক্তাক্ত কাশ্মীর! ডোডায় তল্লাশি অভিযানে সেনা-জঙ্গি গুলির লড়াই, শহিদ সেনা আধিকারিক]

তারপর দিন যত এগিয়েছে তত বেড়ে গিয়েছে– ‘ভারত শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না’ প্রচার। আদানিদের হয়ে নরেন্দ্র মোদির তদবিরের কাহিনি, গোড্ডার বিদ্যুৎ ‘বেশি দামে কিনতে বাধ্য করা’, বাণিজ্য রফতানির ক্ষেত্রে হাজারটা ‘নন-ট‌্যারিফ বেরিয়ার’ সৃষ্টি, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে ‘অমসৃণ’ যাত্রা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়া, ঋণ সদ্‌ব‌্যবহারে দীর্ঘসূত্রতা ও অস্বাভাবিক শর্ত এবং তিস্তা চুক্তির অধরা থেকে যাওয়া বিদ্বেষের মাত্রা চড়িয়েছে। ছোটখাটো কিছু বিষয়ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ অকারণে বাড়িয়ে দেয়। যেমন, স্থল ও বিমানবন্দরে কাস্টমস বা ইমিগ্রেশনে অহেতুক বিলম্ব ও কর্মীদের দুর্ব্যবহার।

যে হাসপাতাল চিকিৎসা-বাবদ একজন ভারতীয়র কাছ থেকে এক লাখ টাকা নেয়, সেই হাসপাতাল বাংলাদেশির কাছ থেকে সেই রোগের চিকিৎসা বাবদ নেয় প্রায় দ্বিগুণ। পাশাপাশি ভারতের ভিসা পাওয়া ও লটারি জেতা প্রায় সমতুল্য। বিরামহীন হাহাকার। কেন যে ভিসা সমস্যার সুরাহা হয় না, কেউ জানে না। বারবার এসব বিষয় দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তোলা হয়েছে, বারবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, অথচ সুরাহা হয়নি। পেঁয়াজ, গম বা চিনির মতো পণ্যের রফতানি ভারত যাতে হুটহাট বন্ধ না করে সেজন্য হাসিনা নিজেও দরবার করেছেন। লাভ হয়নি। একদিকে এসব অসন্তোষ ও অপ্রাপ্তি, অন্যদিকে বাংলাদেশি জনতাকে ‘উইপোকা’ বলে অপমান করা বৈরিতা ও বিদ্বেষের মাত্রা তীব্রতর করেছে। ক্রিকেট মাঠে ভারতের বিরোধী পক্ষকে প্রাণঢালা সমর্থন কিংবা স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষপূর্তিতে মোদিকে আমন্ত্রণের প্রতিবাদে দেশজোড়া বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ভারতের প্রতি বাংলাদেশি জনতার ঘৃণার তীব্রতার প্রমাণ। এসবও হয়তো চাপা পড়ত গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করাতে ভারত হাসিনাকে বাধ্য করালে। ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’ তা করেনি। এই বিপ্লব বুঝিয়ে দিল সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’-এর ঠুনকো পর্ব কোনগুলো। দেশান্তরি হাসিনা এখন নিশ্চয়ই বুঝেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি কিন্তু তার চেয়েও জরুরি গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা এবং আইন যে সবার জন্য এক– তা নিশ্চিত করা।

 

[আরও পড়ুন: ‘অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে!’ আর জি কর কাণ্ডে বিস্ফোরক বিজেপি]

‘বিশ্বস্ত প্রতিবেশী’ ও ‘পরম বন্ধু’ দেশের এই বিপ্লব থেকে ভারতের নীতি নির্ধারকদেরও কিছু শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন– সম্পর্ক পোক্ত হয় আধার সম্মানজনক হলে, সমান-সমান হলে, দু’-পক্ষই নিজেদের জয়ী ভাবলে। হাসিনা বরাবর ভেবে এসেছেন,
অন্যদেরও বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন, তঁার বিরুদ্ধাচরণকারীরা স্বাধীনতা বিরোধী, ইসলামি মৌলবাদী শক্তি। ভারতের বর্তমান শাসককুলও কী আশ্চর্য, যে কোনও বিরোধিতাকে দেশদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদী ও দেশের ঐক্য বিনষ্টকারী বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। সংসদ থেকে ক্ষুব্ধ বিরোধীরা ওয়াক আউট করলে অধ্যক্ষকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ওরা দেশকে দুর্বল করতে চায়, সংবিধানের শাসন চায় না। হিন্ডেনবার্গের তথ্য নিয়ে জেপিসি তদন্তের দাবিকে ‘অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য’ সৃষ্টির চক্রান্ত বলছে।

সন্দেহ নেই, এই পালাবদলে ভারত সতর্ক ও উদ্বিগ্ন। হাসিনা যে নির্ভরতা ও নিশ্চিন্ততা দিয়েছিলেন, বর্তমান শাসকের কাছ থেকে তা এখনই আশা করা বৃথা। সব ডিম একই ঝুড়িতে রাখার বিপদ ও ঝুঁকি কী, ভারত এখন তা টের পাচ্ছে। ভুল শোধরাতে বাড়তি কদম হঁাটতে হবে। এই মুহূর্তে অপেক্ষার নীতি একমাত্র বিকল্প। তা করার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত জানিয়ে দিয়েছে, সে দেশের জনগণের স্বার্থই মুখ্য। দেশ পরিচালনায় নতুন শাসক কুল কত দক্ষ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অদূরভবিষ্যতে বোঝা যাবে। উপদেষ্টারা সফল হলে একরকম, ব্যর্থ হলে অন্যরকম। কী হবে সেই আগাম হদিশ কারও জানা নেই। এটুকু বুঝছি, পিকচার অভি বাকি হ্যায়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
Advertisement