কুণাল ঘোষ, মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী: স্পেন। এক বিচিত্র রবীন্দ্র-রহস্যে মোড়া দেশে এসে পড়লাম। মঙ্গলবার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বঙ্গীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে দুবাই, দিনভর এবং রাত সেখানেই। বুধবার সকালের বিমান ধরে দুপুরের পর মাদ্রিদে। এবং আসার পর থেকেই দু-চারজন স্থানীয় ব্যক্তির কাছেও রবীন্দ্র-রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা শুরু করে দিয়েছি।
রহস্যটা মোক্ষম। বিশ্বকবি বিশ্বের এত দেশ ঘুরেছেন, এমনকী, বহু দেশেই তাঁর প্রেমের সম্পর্কের রোমান্টিক চরিত্র। কিন্তু এই স্পেন, যেখানে তাঁর এত পূজারি এবং পূজারিণী, সেখানে বারবার আমন্ত্রণ সত্ত্বেও তিনি আসেননি কেন? একবার তো দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়েছিল। বিরাট নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন ছিল। তিনি এখানে পৌঁছনোর ঠিক আগেরদিন সফর বাতিলের খবর আসে। আমার কৌতূহল হল, এমনটা কেন?
[আরও পড়ুন: টেমসের মতো গঙ্গার পাড় সাজাবে রাজ্য, জলে নামবে দূষণহীন আধুনিক জলযান]
হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে যা দেখেছি, এখানে দূতাবাস সূত্রে এবং দুই বিশিষ্ট নাগরিকের সৌজন্যে একই তথ্য পেলাম। স্পেনে রবীন্দ্রনাথের বিরাট অনুগামী ছিলেন স্প্যানিশ কবি জুয়ান র্যামন জিমেনেজ। রবীন্দ্র রচনাবলী প্রায় ২০ খণ্ডে অনুবাদ করেছিলেন তিনি। এতবড় অনুবাদ সে সময় আর কেউ করেনি। রবীন্দ্রনাথকে বারবার স্পেনে আসতে অনুরোধ করেন তিনি, সময়টা ১৯১৫ থেকে ১৯২১, রবীন্দ্রনাথ রাজি হন, কিন্তু বারবার বাতিল হয়। শেষবার সংবর্ধনার সব আয়োজন শেষমুহূর্তে বাতিল হলে শুধু জিমেনেজ নন, এখানকার সাহিত্যমহলই হতাশ হয়েছিলেন। সেই সংবর্ধনার আয়োজন নাকি ছিল জমজমাট, স্পেনের সমৃদ্ধ নাগরিকসমাজ সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখানে পৌঁছনোর আগে ঠিক খবর আসে, সফর বাতিল হয়েছে। কারণটা এখানেও স্পষ্ট নয়। আরও অনেকের মত জিমেনেজের বান্ধবী, পরে স্ত্রী, জেনোবিয়া ক্যামপ্রুবিও রবীন্দ্র সাহিত্যের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন। নোবেলজয়ী ‘দ্য সং অফারিংস’-এর গুণমুগ্ধ ছিলেন। এখানেই খটকার প্রশ্নটা হল, বিশ্বকবি এভাবে এড়ালেন কেন? এর কোনও উত্তর এবারও এখানে পাচ্ছি না।
একটা কারণ পেলাম, স্পেনের সাহিত্য সংস্কৃতির যে দর্শন ছিল, তাতে তীব্রতা, উগ্রতার স্রোতটি ছিল অতিরিক্ত। সেটি রবীন্দ্রনাথ সেভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। পরে কল্লোল যুগে স্প্যানিশ কবি লোরকার প্রভাব পরে বাংলা সাহিত্যে। তৈরি হয় এক নতুন ধরনের রোমান্টিকতার, যে রোমান্টিকতার চাঁদের আলোয় ছুরি ফেলা এবং রক্তপাতকে মেনে নেয়। এখানে দার্শনিক স্যান্তানার প্রভাবের কথাও বলতে হবে। তাঁর নতুন মানববাদ এবং নবপ্রেম দর্শন। ভারতীয় সাহিত্যে তার প্রভাব আছে। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বা পাবলো পিকাসো, দু’জনেরই মতো স্পেনের বুলফাইটিংয়ের মতো ভায়োলেন্স সংস্কৃতিটাকে গ্রহণ করতে পারেননি। সেই কারণেই সম্ভবত আমন্ত্রণগুলিতে আর সাড়া দেওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে স্পেন নিয়ে তাঁর অপছন্দ বা অসন্তোষ কখনও প্রকাশ পায়নি। তাই এই তত্ত্ব অবশ্য পুরোপুরি দাঁড়াচ্ছে না। এখনও এখানে রবীন্দ্রপ্রেমী অনেক। এবং তাঁদের কাছেও এটা একটা রহস্য, যার নিশ্চিত সদুত্তর আজ পাওয়া অসম্ভব।
[আরও পড়ুন: রাশিয়ায় কিম-পুতিন করমর্দন, ‘আপনাকে দেখে আনন্দিত’, বললেন রুশ প্রেসিডেন্ট]
যদিও স্পেনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুবই ভালো, তবু বলা যায়, এর মূল কৃতিত্ব পর্তুগালের। স্পেন লাগোয়া পর্তুগালের ভাস্কো-ডা-গামা যদি কালিকটে এসে একদা উপস্থিত না হতেন, তাহলে সেতুবন্ধনটি হয়তো হত না। ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ইবেরীয় উপদ্বীপের তিনটি দেশের অন্যতম স্পেন। আটলান্টিক মহাসাগরের উপসাগর বিস্কায়া স্পেনের উত্তর-পশ্চিম সীমানায়। পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগরের জলভাগ বালেয়ারীয় সাগর ও কাতালান সাগর। দক্ষিণে আফ্রিকা। ইতিহাসের বহু ভাঙাগড়ার পর ইউরোপের সঙ্গে আছে বটে, কিন্তু যুগে যুগে বহু সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্যের পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে সেই সহাবস্থানের ভাঙাগড়া। আপাতত মুখ্যমন্ত্রীর সফরের কদিন এই স্পেনেই, মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনায়। মূল লক্ষ্য লগ্নি টানার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। শিল্প, সংস্কৃতি, খেলার জগতের যে মেলবন্ধন, তাকে পরিকাঠামোয় পরিণত করে বাংলাকে যাতে সমৃদ্ধ করা যায়, সেই অভিযানেই এখানে কাজ শুরু করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ লা লিগার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক। সন্ধ্যার এই বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য বুধবার রাতেই লন্ডন থেকে মাদ্রিদে এসেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। ক্রীড়া বৈঠকের আগে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মাদ্রিদ ও কলকাতা বইমেলা কমিটিও আলোচনায় বসবে। দুই কমিটির মধ্যে একটি ‘মউ’ স্বাক্ষরেরও কথা রয়েছে।
শেষে আবার বলি, এই প্রতিনিধিদলে সাহিত্য ও বইয়ের মেলবন্ধনের জন্য গিল্ডকর্তারা আছেন- সুধাংশু দে, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। স্পেন এবং বাংলা সাহিত্যসেতু গড়ছেন তাঁরা। কিন্তু যে রবীন্দ্রনাথ প্রায় বিশ্বভ্রমণ করেছেন, স্পেনের আমন্ত্রণ তিনি কেন বারবার ফেরালেন, এটা তাঁদের কাছেও একটা ধাঁধা। ত্রিদিববাবুর মতে, “রবীন্দ্রনাথ মন থেকে আসতে চেয়েছিলেন স্পেন। কিন্তু সে সময়ের রাজনৈতিক ডামাডোলের জন্য এড়িয়ে যান। একাধিক দেশের ক্ষেত্রে ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি। তাই বহু অনুরাগী আছে জেনেও এড়িয়ে যান সেই সময়ে।” ত্রিদিব জানাচ্ছেন, এবার মুখ্যমন্ত্রীর সফরে তাঁরা মূলত বইবন্ধনে জোর দেবেন। এক, স্প্যানিশ সাহিত্য বাংলা অনুবাদে কপিরাইট জট কাটানো। দুই, আরও বেশি বাংলা সাহিত্য স্প্যানিশে অনুবাদ। এই দু’টি বিষয়ে জোর দেবেন তাঁরা।