সুমিত বিশ্বাস, বলরামপুর (পুরুলিয়া): যে পরিবার ভোট বয়কটের কথা বলতো। রাতের অন্ধকারে ভোট বয়কটের পোস্টার, ব্যানার ঝুলিয়ে দিত। দিনের বেলাতেও চুপিসারে ভোট থেকে দূরে থাকার প্রচার করতো। একদা সেই মাও এরিয়া কমান্ডারের স্ত্রী-ই ভোটের ময়দানে।
দেওয়াল লেখার তদারকি থেকে মিটিং-মিছিল- বাড়ি- বাড়ি প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কর্মীদের সঙ্গে। আর এই কাজে প্রাক্তন মাও কমান্ডার স্বামীকেও পাচ্ছেন প্রায় সব সময়ই। ভোট চাওয়ার কৌশল কি হবে বধূকে তা বাতলে দিচ্ছেন এক সময় অযোধ্যা স্কোয়াডের লিঙ্কম্যান হিসেবে কাজ করা শ্বশুরও।
পুরুলিয়ার একদা মাওবাদী উপদ্রুত বলরামপুর ব্লকের ঘাটবেড়া-কেরোয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮ নম্বর আসন থেকে তৃণমূলের প্রার্থী তনুজা কুমার। সিপিআই (মাওবাদী) অযোধ্যা স্কোয়াডের প্রাক্তন এরিয়া কমান্ডার তথা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর সাব জোনাল কমিটির সদস্য নন্দ ওরফে নকুল ওরফে আনন্দ কুমারের স্ত্রী। এক সময় মাও লিংকম্যান হিসেবে কাজ করা পঞ্চানন কুমারের বউমা।
[আরও পড়ুন: মিশরে ভারতীয় অর্থে পুষ্ট মসজিদে যাবেন মোদি, বোহরা মুসলিমদের বার্তা!]
এই পরিচয় নিয়েই ভোটের ময়দানে অবতীর্ণ তনুজা। এই প্রথম নির্বাচনে। রাজনীতিতেও। কিন্তু চোখ- মুখ, কথায় দেখলে বোঝা যাবে না তিনি আনকোরা। তাই রাত ন’টাতেও নিজের নামে দেওয়াল লিখনে কর্মীদের সঙ্গে সমানে তদারকি করে যাচ্ছেন। এই আসনে থাকা সিপিএম, বিজেপি প্রার্থীকে হারাতে ভোট যুদ্ধের কৌশল রীতিমতো সাজিয়ে ফেলেছেন। তাই জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী তনুজা বলেন, “আগে কি ছিল সেই সব কথা মনে রাখি না। তখন জঙ্গলমহল ছিল উপেক্ষিত। শুধুই বঞ্চনা। আর তা থেকে আরও অনেক কিছু। এখন বদলে যাওয়া ছবি। সবুজশ্রী থেকে সমব্যথী। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উন্নয়ন প্রকল্পকে সঙ্গী করেই জয় আসবে।”
একদা মাও পরিবারের ভোটপ্রার্থী বধূ শুধু নন, অতীতের ‘মাও মুক্তাঞ্চল’ এই ঘাটবেড়া-কেরোয়াও আর সেইসব দিনের কথা মনে রাখতে চায় না। সেই কারণেই তো এই এলাকায় মহিলার জন্য সংরক্ষিত আসনে এলাকার সবচেয়ে পরিচিত মুখ আনন্দ কুমারের স্ত্রী তনুজা কুমারকে স্থানীয় মানুষজনই তৃণমূলের প্রার্থী করেছেন। তাই অস্ত্র ছেড়ে সমাজের মূল স্রোতে আসা নন্দ কুমার বললেন, “আগের পথ ভুল ছিল তা বুঝতে পেরে মূলস্রোতে ফিরে এসেছি। তাই স্পেশাল হোমগার্ডের চাকরি পেয়ে নিজের ডিউটি করি। এলাকার মানুষজন স্ত্রীকে প্রার্থী করেছেন। তাই যতটা পারছি স্বামী হিসাবে সাহায্য করছি। শুধু এইটুকুই বলবো গণতন্ত্রের শরিক হন। “
বাংলা-ঝাড়খণ্ডের পুলিশের ত্রাস ছিল এই নন্দ কুমার। দুই রাজ্য মিলিয়ে ইউএপিএক্ট সহ ছিল ১৯ টা মামলা। একটাই বেকসুর খালাস হলেও এখনও ১৮ টি মামলা ঝুলছে। ২০১০ সালের ১১ই আগস্ট বাঘমুন্ডির চড়িদায় পুলিশের জালে ধরা পড়ে যান এই নন্দ। ২০১২ সালে জেল থেকে ছাড়া পান। আগের পথ ভুল বুঝতে পেরে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসেন। গ্রামে দুর্গাপূজা শুরু করেন। ক্লাবের সঙ্গে মিশে যান। ক্রিকেট, ফুটবল খেলেন। তারপর ২০১৫ সালে ঘর বেঁধে নতুন সংসারের স্বপ্ন। ২০১৬-র গোড়াতেই স্পেশাল হোমগার্ডের চাকরি। বাবা পঞ্চানন কুমারও চারটি মামলা নিয়ে জেল খেটেছেন। তিনিও এখন স্পেশ্যাল হোমগার্ড। তার কথায়, “ওইসব পুরনো দিনের কথা আর মনে রাখতে চাই না। বধূ অনেক বেশি ভোটে জিতুক। এলাকার উন্নয়ন করুক এটাই চাই।” রাত বাড়ছে ঘাটবেড়ায়। এখন আর মশাল জ্বালিয়ে গণ আদালতে শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয় না। শোনা যায় না গুলি, ল্যান্ডমাইনের শব্দ। ভারী বুটের আওয়াজও অতীত। ঝাঁ- চকচকে পিচ রাস্তায় পথ বাতির আলোয় ঝলমল করে ওঠে তনুজা কুমারকে ঘাসফুল চিহ্নে ভোট দিন।