পালং-মুলো, ফুলকপি-বাঁধাকপি-ওলকপি– শীতের বাঙালি-বাজার আলো করা সব সবজিই সুলভ। তবে সুপ্তি ও লুপ্তির পথে তাদের স্বাদ! বাঙালির জীবনে আর কোনও শীত কি ফিরিয়ে আনবে পালং-মুলোর আটপৌরে চচ্চড়ির পুরনো স্বাদ?
শীত এলে, বিশেষত পঞ্চাশ-পেরনো বাঙালিদের স্মৃতিতে, ফিরে আসতেই পারে, হয়তো আরও অনেক মনকেমনের পরদা সরিয়ে, শীত-অশনের নস্ট্যালজিয়া। কোথায় গেল ঝঁাজালো সরষের তেল অঙ্গে মাখা সেই নিখাদ চন্দ্রমুখীর আলুভাতে, তার নরম-নধর শরীর ও স্বাদ নিয়ে? সেই শরীরে টাটকা কাঁচালঙ্কার উত্তাপ ও আবেদন? আর কি কখনও শীত-রাত্রে বাঙালি ফিরে পাবে গরম রুটির সঙ্গে সাদা মাকড়া বেগুনের রাজযোটক সখ্য? বাঙালির জীবনে আর কোনও শীত কি ফিরিয়ে আনবে পালং-মুলোর আটপৌরে চচ্চড়ির পুরনো স্বাদ?
শীতের নানা ধরনের কপিও আছে বাজারজুড়ে। কিন্তু তাদের স্বাভাবিক স্বাদ বাঙালির পাতে এখন হারানো নিধি। আর, শীতের সেই সবুজ টাটকা রসালো মৃদু-মিষ্টি কড়াইশুঁটি, যা এখন পাওয়া যায় বরফ-ঠান্ডা প্যাকেটে, বিপুল বিস্বাদে সমস্ত ঋতুতেই– কোথায় কবে কীভাবে হারিয়ে গেল তারা সন্ধেবেলা বাঙালির মুড়ি থেকে!
শীতের সবজির এই অন্তর্ধান রসহ্য ভেদ করতে প্রয়োজন ফেলুদার। তিনিও এ বছর ৬০-এ পড়লেন। এবং খঁাটি কলকাতাবাসী এই আইকনিক বাঙালিটির স্মৃতিতে যে
৩০-৪০ বছর আগের বাঙালির পাতে সবজির স্বর্গস্বাদ জেগে আছে, তাতেও সন্দেহ নেই। শীতের বাজারে কতরকমের শাক! নটে, পাট, সরষে, শুষনি, ব্রাহ্মী, মেথি– কোথায় গেল সেই বর্ণময়তা, জীবন্ত স্বাদপ্রবাহ? ফেলুদার এই একটি ব্যাপারে উত্তর আমাদের জানা। ‘সবই তো হাইব্রিড। সেই স্বাদ-গন্ধ পাবেন কোথায়? আর ফিরবে বলেও মনে হয় না। গন ফরএভার।’
এর পর ফেলুদা কি বলবে, তও আন্দাজ করা যায়। বেশির ভাগ বাঙালির সঙ্গে ফেলুদার এই নস্ট্যালজিয়া মিলবে। ‘শীতের শিঙাড়া, তাও তো প্রায় ঘুচেছে বাঙালি-জীবন থেকে। এখন যা পাওয়া যায়, তা অবাঙালি সামোসা, শরীর পালোয়ানের মতো, পেটে কালোমরিচের পুর। লালমোহনবাবুর পাড়ায় একটা নতুন খঁাটি বাঙালি শিঙাড়ার দোকান হয়েছে। অনেকদিন পর খেলাম। শিঙাড়ার খোলটা সেই আগের দিনের মতো, পাতলা, সোনালি, খাস্তা। ভিতরে পুরটা মরিচে কালো নয়, হালকা হলুদ, কঁাচালঙ্কার অল্প টাচ, একটা কিসমিস, আর টিকটিকির লেজের মতো সরু আনমিসটেকেব্ল ফুলকপি– ওটাই হল গিয়ে বাঙালি শিঙাড়ার সিগনেচার, চট করে আর পাওয়া যায় না।’
শীত এলে আরও এক নস্ট্যালজিয়া বাঙালি-মনে আসে বইকি। অশনের নয়, বসনের। প্রসঙ্গত, পুরনো বাঙালিদের মনে আসতে পারে শাল গায়ে ধুতি পরা বসন্ত চৌধুরীকে। ওই আলো বাঙালির শীতকালীন আড্ডা থেকে বিদায় নিয়েছে। শীতের লাবণ্যকেও হারিয়েছি আমরা বহু দিন। সে বেঁচে আছে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’-য়। ‘পরনে সরু-পাড়-দেওয়া সাদা আলোয়ানের শাড়ি, সেই আলোয়ানেরই জ্যাকেট।’ চট করে পাওয়া যাবে পুরনো বাঙালির নস্ট্যালজিয়ার আলোয়ানের শাড়ি, আলোয়ানেরই জ্যাকেট? এখনকার কলকাতায়? এই শীতে?