সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ১৯৯১ সাল। আমূল বদলে যায় ইউরোপ ও এশিয়ার মানচিত্র। তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR)। মিখাইল গর্বাচেভের ‘গ্লাসনস্ত’ বা ‘খোলা হাওয়া’ তুফানে পরিণত হয়ে এক কমিউনিষ্ট মহাশক্তিকে কীভাবে শেষ করে দিয়েছিল তা ইতিহাস। তারপর বরিস ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে ‘পোকায় খাওয়া’ ও রক্তাল্পতায় ভোগা রাশিয়ান ফেডারেশনের সে করুণ দশা। কিন্তু এবার দেশটির রাশ ধরেছেন ‘লৌহমানব’ ভ্লাদিমির পুতিন। যুদ্ধকে হাতিয়ার করে ফের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন তিনি। আবারও কি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র গড়তে চায় ক্রেমলিন? সেই দাবার ছকে কি ইউক্রেন বোড়ে মাত্র? এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর হয়তো-বা লুকিয়ে রয়েছে রুশ সামরিক অভিযানের মধ্যে। একনজরে দেখে নেওয়া যাক পুতিনের নেতৃত্বে মস্কোর সামরিক অভিযানের খতিয়ান।
চেচনিয়া যুদ্ধ: ১৯৯১ সালে পতন হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম নেয় ‘রাশিয়ান ফেডারেশন’। আর সুযোগ বুঝে স্বাধীনতা ঘোষণা করে চেচেনরা। স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে ‘চেচেন রিপাবলিক অফ ইচকেরিয়া’। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ওই অঞ্চল ফিরে পেতে চেচেন বিদ্রোহীদের দমনে ফৌজ পাঠায় মস্কো। কিন্তু ভয়াবহ লড়াইয়ে পর ১৯৯৬ সালে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে আসে রুশ সেনা। ওই যুদ্ধই পরিচিতি পায় প্রথম ‘চেচেন ওয়ার’ হিসেবে। তারপর ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে আবারও চেচনিয়ায় সেনা পাঠায় রাশিয়া। তুমুল লড়াইয়ের পর ২০০০ সালে চেচেন রাজধানী গ্রজনিকে বোমা মেরে কার্যত ধুলোয় মিশিয়ে দেয় রুশ বাহিনী। দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধে জয় হয় মস্কোর। একইসঙ্গে রুশ রাজনীতিতে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা পান পুতিন।
[আরও পড়ুন: বিদেশে ফৌজ পাঠানোর অনুমতি দিল রুশ পার্লামেন্ট, ইউক্রেন দখলে আরও আগ্রাসী পুতিন!]
রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধ: ২০০৮ সালের আগস্টে জর্জিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধে রাশিয়ার। সাউথ ওসেশিয়া নিয়ে সংঘাতে জড়ায় দুই দেশ। বিতর্কিত অঞ্চলটির দখল ছিল রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে। সেই ভূখণ্ড ফের দখল করতে আগস্টে অভিযান শুরু করে জর্জিয়ার ফৌজ। বিদ্রোহীদের মদতে পালটা হামলা চালায় রাশিয়ার সেনাবাহিনী। প্রায় পাঁচদিন ধরে চলা যুদ্ধে মৃত্যু হয় কয়েক হাজার মানুষের। পরাজয় হয় অধুনা সোভিয়েত অন্তর্ভুক্ত দেশ জর্জিয়ার। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে থাকা সাউথ ওসেশিয়া ও আবাকাজি প্রদেশকে ‘স্বাধীন’ বলে ঘোষণা করে মস্কো। তারপর থেকেই সেখানে ফৌজ মোতায়েন রেখেছে রাশিয়া। বিশ্লেষকদের মতে, সেবারও হামলার জন্য রুশ পার্লামেন্টকে রাজি করিয়েছিলেন পুতিন।
সিরিয়ায় রুশ সেনার অভিযান: ২০১৫ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থনে ফৌজ পাঠায় রাশিয়া। ইসলামিক স্টেট ও বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আসাদের ফৌজের হয়ে প্রবল বোমাবর্ষণ করে রুশ যুদ্ধবিমানগুলি। বলা যায়, মস্কোর মদতেই মুসলিম জঙ্গিদের শায়েস্তা করা এবং বিদ্রোহীদের ঘাঁটিগুলি দখল করতে সক্ষম হয় আসাদের বাহিনী। সেখানেও আমেরিকার প্রভাব খর্ব করতে রীতিমতো উঠেপড়ে চেষ্টা চালিয়েছিল রাশিয়া ও ইরান।
ক্রিমিয়া জবরদখল: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই ইউক্রেনে মস্কো বিরোধী হাওয়া প্রবল হয়ে ওঠে। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের আরও কাছাকাছি চলে আসে কিয়েভ। জনতার রায়ে রাশ টানতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে দেশটির রুশপন্থী সরকার। কিন্তু ২০১৪ সালে ইউরোপপন্থী জন আন্দোলনের ফলে গদি ছাড়তে হয় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকভিচকে। জবাবে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে রাশিয়া। দ্বিখণ্ডিত হয় ইউক্রেন। তবে মস্কোর এহেন আগ্রাসনকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি আন্তর্জাতিক মঞ্চ।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্ত সংঘাত: দীর্ঘ সংঘাতের পর সোমবার রুশপন্থী বিদ্রোহীদের দখলে থাকা ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলের ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয় রাশিয়া। ফলে ক্রিমিয়ার পর আবারও বিভক্ত হয় ইউক্রেন। এহেন চরম উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে জরুরি বৈঠকে বসেছে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা বৈঠক। পরিস্থিতির মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি। সবমিলিয়ে, প্রাক্তন সোভিয়েত সদস্য দেশটিকে কোনও মতেই ন্যাটো সামরিক গোষ্ঠীতে যোগ দিতে দেবে না রাশিয়া তা স্পষ্ট। বিশ্লেষকদের মতে, সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সেই গৌরব ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর ভ্লাদিমির পুতিন। এবং দাবার ওই বৃহতম খেলায় ইউক্রেন বোড়ে মাত্র।