shono
Advertisement

আমেরিকার আবিষ্কর্তা কলম্বাস ছিলেন নৃশংস, অত্যাচারী! এই ঘৃণ্য ইতিহাস জানেন?

'অত্যাচারী' ও 'বর্ণবিদ্বেষী' কলম্বাসের কথা শুনলে শিউরে উঠতে হয়।
Posted: 05:47 PM Sep 16, 2022Updated: 05:47 PM Sep 16, 2022

বিশ্বদীপ দে: ইতিহাস মাঝে মাঝেই পাশ ফিরে শোয়। প্রতিনিয়ত পালটে যেতে থাকে ঘটনাক্রম, অতীতের বুকে লুকিয়ে থাকা সত্য়ি। আর একথা বলতে বসলে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের (Christopher Columbus) নাম উঠে আসবেই। ছোটবেলায় ইতিহাস কিংবা সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে আমেরিকার আবিষ্কর্তার নাম পড়ার সময় মনের ভিতরে ভ্রমণপিপাসু এক সাহসী নাবিকের ছবি ফুটে ওঠে। যিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীটাকে ‘এক্সপ্লোর’ করতে। আর সেই নেশাই তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছিল এক নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করার। কিন্তু এহেন এক মানুষের চরিত্রও যে ছিল পুরু ছায়ায় ঢাকা, তা সেসময় জানা যায় না। পরে ‘অত্যাচারী’ ও ‘বর্ণবিদ্বেষী’ কলম্বাসের কথা শুনলে সব কিছুই গুলিয়ে যেতে থাকে।

Advertisement

আমরা সবাই জানি, আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিলেন কলম্বাস। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর ও মধ্য আমেরিকার উপকূলের আদিবাসী মানুষদেরই তিনি ভ্রান্তিবশত ‘ইন্ডিয়ান’ আখ্যা দিয়ে বসেন। অবসরপ্রাপ্ত অঙ্কোলজিস্ট লুইস বেলিজেট একটি লেখায় লিখেছেন, ‘কলম্বাস দাসপ্রথার উদ্ভাবন করেননি ঠিকই। কিন্তু প্রতিহিংসার সঙ্গে সেটির অনুশীলন করেছিলেন।’ আরেক জায়গায় তাঁর দাবি, ‘কলম্বাস দাসত্ব, নির্যাতন ও ধর্ষণের আমদানি করেছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত ‘নতুন বিশ্বে’র সর্বত্র।’ 

[আরও পড়ুন: ‘গান্ধীকে সরিয়ে দেশের নোটে মোদির মুখ বসবে এবার’, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীর ছেলের খোঁচা প্রধানমন্ত্রীকে]

যাই হোক, তাঁর লেখায় কলম্বাসের ডায়রির যে অংশ তিনি তুলে ধরেছেন তা পড়লে চমকে উঠতে হয়। কলম্বাস লিখছেন, ‘ওদের শরীর সুগঠিত, সুন্দর ও সুঠাম আকৃতির… ওদের কাছে অস্ত্র তো নেই-ই। এমনকী সেটার ব্যবহারও জানে না ওরা। আমি যখন ওদের দিকে তরোয়াল এগিয়ে দিলাম, ওরা ভুল করে সেটার ধারালো অংশে হাত দিয়ে ফেলায় রক্তারক্তি কাণ্ড। ওরা লোহার ব্যবহার জানে না। এরা দারুণ দাস হতে পারবে। ৫০ জন মিলেই আমরা ওদের আয়ত্তে এনে ফেলতে পারব এবং ওদের দিয়ে যা খুশি করাতে পারব।’

১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর কলম্বাস এসে পৌঁছন সান সালভা দর দ্বীপে। আজকের বাহামাসে অবস্থিত সেই দ্বীপটিতে পৌঁছে এক অজানা দেশ দেখার রোমাঞ্চের চাইতে কলম্বাসের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানকার সরল মানুষরা। যাদের সহজেই ক্রীতদাস বানানো যাবে!

কলম্বাসের প্রথম অভিযানের মানচিত্র

[আরও পড়ুন: ‘গ্রেপ্তার করুন’, সিসোদিয়ার চ্যালেঞ্জের পরদিনই দিল্লির আবগারি মামলায় দেশজুড়ে তল্লাশি ইডির]

আরেক জায়গায় রয়েছে ‘ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে যখন আমি পৌঁছলাম, প্রথম দ্বীপটায় নেমেই আমি কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাকে জোর করে পাকড়াও করলাম। যাতে ওরা আমাদের ভাষা বুঝে আমাদের প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে পারে।’

তাঁর দ্বিতীয় অভিযান ছিল আজকের হাইতিতে। কলম্বাস যার নাম দিয়েছিলেন হিস্প্যানিওলা। সেখানে উত্তর আমেরিকার আরাওয়াক জনজাতির হাজার হাজার মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছিলেন তিনি। তাদের মধ্যে ৫০০ জনকে স্পেনে বিক্রির চালান করে দেওয়া হয়। যাদের মধ্যে ২০০ জন যাত্রার সময়ই মারা যায়!

এখানেই শেষ নয়, ‘হিস্ট্রি অফ দ্য ইন্ডিজ’ বইয়ে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মেলে। জানা যায় আরাওয়াক নারী ও পুরুষ তো বটেই কলম্বাসের অত্যাচারের পরোক্ষ শিকার হয় শিশুরাও। কিউবায় মাত্র ৩ মাসে মারা যায় ৭ হাজার শিশু! আসলে তাদের মায়েরা কাজের ধকল, অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে এমন শারীরিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করেছিলেন স্তনদুগ্ধের ধারাই শুকিয়ে গিয়েছিল। ফলে না খেয়ে মৃত্যু হয় তাদের। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় বহু মা তাঁদের সদ্যোজাত সন্তানদের জলে ভাসিয়ে দিতেন! ওই বইয়ে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ওই জনজাতির পুরুষদের মৃত্যু হয়েছিল খনিতে, নারীরা কাজের চাপে ও শিশুরা মায়ের দুধ না পেয়ে। চোখের সামনে এক স্বচ্ছল জনজাতির জীবনে নেমে এসেছিল মৃত্যু ও বিপর্যয়ের কালো ছায়া। যে ছায়ার আসল নির্মাতা কলম্বাস!

কলম্বাসের বাড়ি

এমনটাই বলছে এই সব বই। এমনকী, কলম্বাসের প্রতি সবচেয়ে সহানুভূতিশীল, তাঁর আত্মজীবনীকার হার্ভার্ডের স্যামুয়েল এলিট মরিসনও মেনে নিচ্ছেন, ”যে নিষ্ঠুর নীতির প্রবর্তন করেছিলেন কলম্বাস তা পরবর্তী সময়ে তাঁর উত্তরসূরীরা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলশ্রুতি ছিল সম্পূর্ণ গণহত্যা।”

হ্য়াঁ, একথা সত্য়ি যে কলম্বাস মোটেই দাসপ্রথার প্রবর্তন করেননি। তাঁরও বহু আগে থেকে সভ্যতার ধ্বজাধারীরা আবিষ্কার করে ফেলেছিল মানুষ হয়ে আরেক মানুষকে পশুর মতো খাটানোর কৌশল। সেই প্রথারই নির্মম প্রয়োগ করেছিলেন কলম্বাস। তবে কলম্বাস যে ওই ক্রীতদাসদের হত্যা করতে চেয়েছিলেন তা নয়। কিন্তু যেভাবে তিনি ওই সরল মানুষগুলির সুন্দর জীবনে অন্ধকার প্রবেশ করিয়েছিলেন তা আসলে হত্যারই মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে। গবেষক ক্রিস লেন মনে করেন, কলম্বাস যা করেছিলেন সেটাকে ‘গণহত্যা’ বলা ঠিক নয়। তেমন কোনও উদ্দেশ্য সত্য়িই ছিল না কলম্বাসের। কিন্তু পরিবার সূত্রে পাওয়া বাণিজ্যের কৌশল ও অবহেলার কারণে তিনি মানুষকে ঠেলে দিয়েছিলেন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।

সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ছবির কথা মনে পড়তে পারে। মনমোহন মিত্র ও পৃথ্বীশ সেনগুপ্তর সংলাপের মধ্যে সভ্যতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। প্রায় সারা জীবন অরণ্যের মানুষদের সঙ্গে কাটানো মনমোহন যখন অরণ্যচারী মানুষের জয়গান গাইছিলেন সেই সময় পৃথ্বীশ তাঁকে খোঁচা মেরে প্রশ্ন করেছিলেন, ”ক্যার্নিভারিলিজমকে আপনি সভ্যতার কোন স্তরে ফেলবেন?” কটাক্ষটা বুঝতে পেরে মনমোহন তাঁর মেধাদীপ্ত উচ্চারণে বলেছিলেন, ”সভ্য! সভ্য কোথায়? বর্বর, বারবারিক। সভ্য কে জানেন? সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ, যে আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসীসমেত একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।”

‘আগন্তুক’ ছবির সেই দৃশ্যে মনমোহনের ভূমিকায় উৎপল দত্ত

তাঁর ওই কটাক্ষের কথা যেন কলম্বাসের কথাও মনে করিয়ে দেয়। এত বছর পেরিয়ে এসে ইতিহাস তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেয় এমন এক পরিসরে, যেখানে নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় সেই ভ্রমণপিপাসু এক্সপ্লোরারকে। যাঁর হৃদয়ে নতুন দেশ দেখার নেশার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী লোভও কম ছিল না। যদিও ইতিহাস সাক্ষী, একা কলম্বাসকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। একই দোষে দোষী ভাস্কো ডা গামা থেকে হার্নান কর্তেজও। নতুন দেশে অভিযান চালানোর সময় তাঁরা কেউই তাঁদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকে লুকিয়ে রাখতে পারেননি। 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement