shono
Advertisement

Breaking News

US Election

গাজার ভাগ্য থেকে ইউক্রেনের নিয়তি! মার্কিন ভোটবাক্সেই বিশ্বের ভবিষ্যৎ

আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
Published By: Biswadip DeyPosted: 07:17 PM Nov 02, 2024Updated: 09:11 AM Nov 03, 2024

বিশ্বদীপ দে: আর মাত্র কয়েকদিন। আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন মুলুকের নির্বাচন। কে হবেন আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট, সেদিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। আসলে কেবলই একটি দেশের নির্বাচন মাত্র নয়। আমেরিকার ভোটবাক্সে লুকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্বের অভিমুখ। রাষ্ট্রসংঘ জানিয়েছে, এবছরটা নির্বাচনের ক্ষেত্রে 'মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড়' বছর। ৭২টি দেশের ৩৭০ কোটি মানুষ এবার ভোটাভুটিতে অংশ নিয়েছিলেন বা নেবেন। যার মধ্যে ছিল এদেশের লোকসভা নির্বাচনও। কিন্তু মার্কিন নির্বাচন যে ভূ-রাজনৈতিক দাঁড়িপাল্লায় সবচেয়ে ভারী, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ওয়াকিবহাল মহল। তাই সেদিকে নজর সকলেরই।

Advertisement

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আচমকাই ইউক্রেনে চলে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। উদ্দেশ্য, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির প্রতি সংহতি প্রদর্শন। সেই সময়ই জেলেনস্কিকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ''আমেরিকা গোটা বিশ্বের বাতিঘর।'' সেই কথার সুর ধরেই বলা যায়, এহেন অমোঘ বাতিঘরের দায়িত্বে এবার কারা, রিপাবলিকান নাকি ডেমোক্র্যাটরা... সেই উত্তরই খুঁজছেন বিশেষজ্ঞরা। একদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি বলেন ''বিশ্বায়ন নয়, আমেরিকায়ন।'' অন্যদিকে কমলা হ্যারিস, যাঁর মতে, ''এটা স্পষ্ট যে এই অস্থির সময়ে আমেরিকা পিছু হটতে পারে না।'' দেখে নেওয়া যাক, এবারের মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল কোন কোন দিকে বড়সড় পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে। ভারতের ক্ষেত্রেও বা ট্রাম্প-কমলায় কী ফারাক হতে পারে?

সামরিক শক্তি

''ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের দুঃস্বপ্ন।'' ন্যাটোর প্রাক্তন সহ-মহাসচিব রোজ গোটেমোলার বিবিসির সঙ্গে কথা বলার সময় সরাসরি এই মন্তব্যই করেছেন। এবং তাঁর মতে, এটা নিয়ে তিনি লুকোছাপা করতে চান না। বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা যদি মসনদে প্রত্যাবর্তন ঘটান তাহলে সকলেরই মাথায় থাকবে একদা ন্যাটো থেকে সরে আসা নিয়ে তাঁর দেওয়া হুঁশিয়ারির কথা। মনে রাখতে হবে, ন্যাটোর ৩১টি সদস্য দেশের মোট সামরিক বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশই আসে মার্কিন বরাদ্দ থেকে। অন্যদিকে সেদেশের সামরিক খাতে মোট খরচ চিন, রাশিয়া-সহ দশটি দেশের মোট সামরিক বাজেটের চেয়েও বেশি! তাই ট্রাম্প চান, ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলি নিজেদের নিরাপত্তা খাতে খরচ আরও বাড়াক।

কাজেই ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ন্যাটোর উপরে চাপ বাড়বে। বরং কমলা হ্যারিস জিতলে তিনি যে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েই চলতে চাইবেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত গোটেমোলার। কিন্তু সেই সঙ্গেই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেনেট এবং হাউসের ক্ষমতা থাকতে হবে হ্যারিসেরই হাতে। সেখানে রিপাবলিকানদের সংখ্যাধিক্য থাকলে তাঁদের চাপে পড়ে এবিষয়ে এগোতে পদে পদে ধাক্কা খেতে হবে ডেমোক্র্যাট নেত্রীকে।

ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় সামরিক মদতদাতা

৩১ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত যা পরিসংখ্যান তাতে রুশদের সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সবচেয়ে সাহায্য করেছে আমেরিকাই। এবং সেটা বাকি দেশগুলির তুলনায় অনেক অনেক বেশি। যেখানে কিয়েভে সামরিক খাতে মার্কিন বরাদ্দ ৬১.১ বিলিয়ন ডলার, সেখানে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা জার্মানির বরাদ্দ মাত্র ১১.৪ বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় স্থানে থাকা ব্রিটেন দিয়েছে মাত্র ১০.১ বিলিয়ন। বাকিদের ক্ষেত্রে অঙ্কটা বিলিয়নের নিক্তিতে দুই অঙ্কেও পৌঁছয়নি। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে আমেরিকা ইউক্রেনের পাশে এভাবে থাকবেন কিনা তা ঘোর সংশয়ে। কমলার 'স্টান্স' পূর্বসূরি বাইডেনের মতোই হবে। কিন্তু সেনেট ও হাউসে রিপাবলিকানদের চাপ সামলে তিনি একই রকম উদারহস্ত থাকতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

শান্তিস্থাপকের ভূমিকা

শীতল যুদ্ধের পরবর্তী পৃথিবীতে সবচেয়ে রণরক্তময় সময় এখনই। মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে যেমন যুদ্ধের ঘন কালো মেঘ, আবার ইউক্রেনের মতো দেশের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়নি প্রায় তিন বছরেও। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও কমফর্ট এরো বিবিসির সঙ্গে কথা বলার সময় জানিয়েছিলেন, ''শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক নেতা। কিন্তু বিভিন্ন দেশের মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্ব নিরসনে সহায়তার ক্ষমতা খর্ব হয়ে গিয়েছে।''

যদি ট্রাম্প জেতেন তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াবে? রিপাবলিকান নেতা বার বার বলেছেন, 'গণহত্যা' ছেড়ে শান্তির পথে ফিরে আসার এটাই সময়। কিন্তু এরই সঙ্গে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে তাঁর পরামর্শ, ''আপনার যা মনে হয় তাই করুন।'' তবে মধ্যপ্রাচ্যে তিনি শান্তি ফেরাতেই চান বলে দাবি ট্রাম্পের। অতি সম্প্রতি সৌদি আরবের আল আরবিয়া টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন তিনি। দাবি করেছেন, ২০২০ সালের 'আব্রাহাম অ্যাকর্ড'কে প্রসারিত করবেন তিনি। এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি যে ইজরায়েল ও আরব দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ককে ক্রমে স্বাভাবিক করে তুলবে সেব্যাপারে নিশ্চিত ট্রাম্প। আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ক্ষেত্রে 'শক্তিশালী' পুতিনের প্রশস্তি তিনি প্রায়ই করে থাকেন। ফলে এটা পরিষ্কার তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে চাইবেন।

অন্যদিকে কমলা হ্যারিস বার বার বলেছেন, ইউক্রেনের পাশে থাকতে পেরে তিনি গর্বিত। এবং তিনি আগামিদিনেও তিনি কিয়েভের পাশেই থাকবেন। তবে সব মিলিয়ে যিনিই নির্বাচিত হোন, যুদ্ধে বিদীর্ণ পৃথিবীর পরিস্থিতি আরও খারাপই হবে।

চিনের সঙ্গে বাণিজ্য

এখনও পর্যন্ত চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জানাননি, ট্রাম্প না কমলা কাকে সমর্থন করবেন তাঁরা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন, চিনের প্রতি কড়া মনোভাব অব্যাহত রাখবে হোয়াইট হাউস। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ২০১৮ সালে চিনা পণ্য আমদানিতে ২৫০ বিলিয়ন ডলার শুল্ক আরোপ করে আমেরিকা। 'বদলা' নিতে চিন মার্কিন পণ্যের আমদানিতে চাপিয়ে দেয় ১১০ বিলিয়ন ডলার শুল্ক। ট্রাম্প জিতলে তিনি কঠোর অবস্থানেই থাকবেন এটা নিশ্চিত। যদিও জিনপিংয়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো বলেই দাবি রিপাবলিকান নেতার। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন মসনদে ফিরলে তিনি চিন ও তাইওয়ানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলেও মার্কিন সেনা পাঠাবেন না। তাঁর কথায়, ''জিনপিং আমাকে পছন্দ করেন।'' সেই সঙ্গেই স্বভাবোচিত ভঙ্গিতে ট্রাম্প এও মনে করিয়ে দিয়েছেন, চিনা প্রেসিডেন্ট ভালোই জানেন তিনি কেমন 'পাগলাটে'!

এদিকে ডেমোক্র্যাটরা যদি ক্ষমতায় আসেন তাহলেও চিন-বিরোধী অবস্থান বজায় রাখবে আমেরিকা। কেননা বাইডেন ক্ষমতায় এসেও কিন্তু চিনের উপরে আরোপিত শুল্ক বহাল রেখেছিলেন। আবার এবছরের সেপ্টেম্বরে তাঁর প্রশাসন কিছু চিনা পণ্যের শুল্ক বৃদ্ধি করারও সিদ্ধান্ত নেয়। কাজেই কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় এলেও একই নীতি বজায় থাকবে তা নিশ্চিত। সুতরাং রিপাবলিকান হোক ডেমোক্র্যাট, চিনের দিকে তীক্ষ্ণ নজর বজায়ই থাকবে আমেরিকার। তবে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ রানা মিটারের মত অবশ্য অন্য। তিনি মনে করছেন, কমলা হ্যারিস জিতলে দুদেশের সম্পর্কের ধীরগতিতে হলেও উন্নতি হবে। কিন্তু ট্রাম্প জিতলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। যদিও চিনা নেতাদের ইঙ্গিত, কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্প- যিনিই ক্ষমতায় আসুন পরিস্থিতি তাঁদের জন্য মোটেই সুবিধার হবে না।

জলবায়ু সংকট

‘ড্রিল, বেবি, ড্রিল’। অর্থাৎ বেশি বেশি করে তেল বা গ্যাসের খনি খুঁড়তে হবে। রিপাবলিকানদের এই স্লোগান বুঝিয়ে দেয় জলবায়ু নিয়ে তাদের মনোভাব। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস এখনও তাঁর ব্যক্তিগত মত পরিষ্কার করেননি এই বিষয়ে। কিন্তু মানবাধিকার বিষয়ক রাষ্ট্রসংঘের প্রাক্তন হাইকমিশনার মেরি রবিনসনের মতে, কমলা হ্যারিস অবশ্যই আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয়ে ডেমোক্র্যাটদের দৃষ্টিভঙ্গিকেই মাথায় রেখে এগোবেন। সবুজ জ্বালানিকে উৎসাহিত করবেন।

গত সপ্তাহেই ট্রাম্প দাবি করেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তন হল 'সর্বকালের অন্যতম সেরা কেলেঙ্কারি'। ক্ষমতায় ফিরলে তিনি ফের আমেরিকাকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসবেন। সোজা কথায় ডেমোক্র্যাটদের জলবায়ুবান্ধব নীতিগুলি তিনি বিসর্জন দেবেন। তবে রবিনসন বলছেন, কাজটা অত সহজ হবে না। কেননা গত কয়েক বছরে এই বিষয়ে জল যতটা গড়িয়েছে তাকে ফের উলটো স্রোতে বইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বোধহয় হবে না ট্রাম্পেরও। তবে এখানে আরও একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার। এবারের নির্বাচনী প্রচারে কিন্তু কোনও পক্ষই জলবায়ু সংকটের ইস্যুটি নিয়ে খুব বেশি কিছু বলেনি। অথচ চিনের পরই সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ আমেরিকাই। কাজেই আগামিদিনে তারা এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ করে সেটা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হবে তা সংশয়াতীত। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরলে পরিস্থিতি অনেক বেশি ঘোরালো হবে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক

গোটা বিশ্বের সঙ্গে ভারতেরও নজর যে মার্কিন নির্বাচনের দিকে পুরোদস্তুর থাকবে তা বলাই বাহুল্য। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প জিতলেই নয়াদিল্লির সাউথ ব্লক বেশি খুশি হবে। কমলা হ্যারিসের ভারত-যোগ যতই গভীর হোক, মোদি সরকারের কাছে ট্রাম্পই যে প্রথম পছন্দ তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। মোদি ও ট্রাম্পের অতীত সম্পর্কের কথা কারও অজানা নয়। ২০১৯ সালের টেক্সাসে ট্রাম্পের প্রচারে নেমে পড়তে দেখা গিয়েছিল মোদিকে ('হাউডি মোদি' স্মরণ করুন)। ভারতের নজর রয়েছে ট্রাম্পের কট্টর চিন-বিরোধী অবস্থানের দিকেও। রিপাবলিকান নেতা ক্ষমতায় এলে যে অগ্রাধিকারের তালিকায় পাকিস্তানের থেকে ভারতই বেশি গুরুত্ব পাবে সেটা ধরেই নেওয়া যায়। ট্রাম্প-পুতিন সখ‌্যও ভারতকে স্বস্তি দেবে। তাছাড়া ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে যে বেজিংয়ের অস্বস্তি বাড়বে তাও নিশ্চিত। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কোনও দুর্বলতা দেখাননি মোদি প্রশাসনের উপর। মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত‌্যাদি কিছু প্রশ্নে হ‌্যারিস একাধিকবার মোদি প্রশাসনের সমালোচনাও করেছেন। কাজেই ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কথা মাথায় রেখেও ভারত যে তাঁর মতো বন্ধুকেই মার্কিন মসনদে ফের একবার দেখতে চাইবে তা বলাই যায়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • আগামী ৫ নভেম্বর মার্কিন মুলুকের নির্বাচন। কে হবেন আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট, সেদিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব।
  • আসলে কেবলই একটি দেশের নির্বাচন মাত্র নয়।
  • আমেরিকার ভোটবাক্সে লুকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্বের অভিমুখ।
Advertisement