শঙ্খ ঘোষ বলছেন। তরুণ কবিরাও বলছেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না আর একটা তীব্র তীক্ষ্ণ স্বর। এখানেই সুনীল না থাকা অনুভব করেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী।
সুনীলদা বেঁচে থাকলে সেপ্টেম্বরের সাত তারিখে চুরাশি বছরের হতেন। ‘বেঁচে থাকলে’ কথাটা লিখেই মনে হল, ভুল লিখলাম। বেঁচেই তো আছেন। তাঁর কবিতার কত লাইন প্রবাদের মতো ব্যবহার হয় কথাবার্তায়। কাকাবাবু-সন্তু-জোজোরা ফিরে ফিরে আসছে চলচ্চিত্রে। বইগুলো পঠিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। শিল্পীরা তো শরীরে ততটা নয়, সৃষ্টিতেই বেঁচে থাকেন। কিন্তু শরীরে না থাকার শূন্যতাটাও যেন অনুভব করি বারবার। ঠিক এই সময়টাতে সুনীলদা’কে দরকার ছিল। যখন মুখ বন্ধ করার চেষ্টা, একরৈখিক চিন্তাভাবনা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। উনি শরীরে থাকলে চুপ করে থাকতেন না। ওঁর ছিল একটা নেতৃত্ব দেওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা। এবং কবি-লেখক সংস্কৃতি কর্মীরা নানা সংকটে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকেছে। একজন শিল্পী শরীর অবসানের পরেও অনেক দূর হেঁটে যেতে পারেন যখন তিনি তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির বাইরেও নানা কাজের মাধ্যমে অবদান রাখেন সমাজে। বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর উদ্বেগই ছিল না শুধু, পথে নেমে আন্দোলনও করেছিলেন। রাজ্য সরকারের কাছে বারবার দরবার করেছেন বাসের নম্বর, দোকানের সাইনবোর্ড ইত্যাদি বাংলায় লেখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। সরকারি কাজে বাংলা ভাষাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে। মূলত ওঁর জন্যই ব্রিটিশ জিহ্বায় উচ্চারিত ক্যালকাটা এখন আন্তর্জাতিকভাবে কলকাতা।
[ শিক্ষক দিবসে গুরুদের স্মৃতিচারণায় সফল তারকারা ]
যে কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। আজ অসমের ব্যাপারে কিংবা ধর্মীয় খ্যাপামির বিরুদ্ধে কথা বলতেন, লিখতেন।
এখন যখন আমরাও সুনীলের কবিতার লাইন উচ্চারণ করি–
ইচ্ছা করে ধর্মাধর্ম নীলাম করি মুর্গিহাটায়
মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি
আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না…
তখন মনে হয় এর পর আরও কত কী বলার ছিল। শঙ্খ ঘোষ বলছেন, তরুণ কবিরাও বলছেন, সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না আর একটা তীব্র তীক্ষ্ণ স্বর। এখানেই সুনীল শূন্যতা অনুভব করি। আমি সুনীলদার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে কখনওই ছিলাম না। এমনকী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সুনীলদা সম্বোধন করা যায় কি না এ নিয়েও দ্বিধান্বিত ছিলাম। ওঁর যে আপাত গাম্ভীর্য, রাশভারি চেহারা এবং প্রজ্ঞা, সেটাই বাধা ছিল। জানি না শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্ত’র অনুজ নাট্যকর্মীরা শম্ভুদা বা উৎপলদা ডাকতে পারতেন কি না। শঙ্খ ঘোষকে ক’জন শঙ্খদা বলতে পারেন জানি না। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সুনীলবাবুও বলা যায় না। দ্বিধা কেটেছিল মধ্যপ্রদেশের সিংরোলিতে একসঙ্গে দু’-রাত কাটিয়ে। বুঝেছিলাম পাণ্ডিত্যকে প্রতিভা দিয়ে কী ভাবে ঢেকে রাখতে হয়, এবং প্রতিভাকে সারল্য দিয়ে।
[ ছবির জন্য গান তৈরি করতে আগ্রহী রাঘব, চান দায়িত্ব ]
ওঁর বাড়ির রবিবারের আড্ডায় দু’একবার গিয়েছি। বুঝেছিলাম কবিরা কত প্রশ্রয় পায় তাঁর কাছে। বিশেষত নবীন কবিরা। ওঁর তো একটা কবিতাতেই আছে–
‘নবীন কিশোর তোমায় দিলাম অামার যা কিছু ছিল আভরণ
দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা। রাত্রির মাঠে চিৎ হয়ে থাকা
এসব এখন তোমারই, তোমার হাত ভরে নাও আমার অবেলা
আমার দুঃখবিহীন দুঃখ, ক্রোধ, শিহরন।’
নবীন কিশোর মানে স্পষ্টতই নবীন কবি।
নিজেও আদ্যন্ত কবিই ছিলেন সত্তায়, যদিও গদ্য থেকেই তাঁর বড় বড় পুরস্কারগুলি অর্জিত হয়েছিল।
তাঁর রবিবারের বৃত্তে গদ্যলেখকদের চোখে পড়েনি। তবে কয়েকজন কবির কাছে শুনেছি আমার গদ্য পছন্দ করতেন তিনি। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় কয়েকবার গল্প ছাপিয়েছিলেন উনি। ওঁর যখন হাঁটু অপারেশন হয়, তখন একটা গল্প সংখ্যা করেছিলেন, এবং আমাকেও একটি গল্প লিখতে বলা হয়েছিল। উনি নিজেই প্রুফ দেখেছিলেন। অামার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করে আমাকে ভাল লাগার কথাটা যে ভাষায় জানিয়েছিলেন, সেই শব্দগুলি প্রায় রত্নের মতোই যত্নে রেখেছি বুকে।
সুনীলদার অবর্তমানে এখন ও পত্রপত্রিকাগুলি কেমন যে অপূর্ণ লাগে। কী যেন নেই। যেন প্রিয় কারও অাসার কথা ছিল, সে আসেনি। সেমিনার, পত্রপত্রিকায় উদ্বোধন অনুষ্ঠান এসবও যেন নুন কম মনে হয়। যেন ওঁর সেই কবিতাটা বাতাসে ভাসে-
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
এখন নবীনতর কবিরা এসেছে। ভালই লিখছে ওরা। ওরা বুঝল না সেই, সেই গাছ নেই সেই গাছ নেই মাথার উপরে।
The post ‘সুনীলদা নেই তাই সর্বত্র নুন কম মনে হয়’ appeared first on Sangbad Pratidin.