shono
Advertisement

রাহুল দ্রাবিড়, হেরে যাওয়ার গানে আপনি গলা মেলাবেন না প্লিজ

চূড়ান্ত সফল পেপ গুয়ার্দিওলার সঙ্গে ক্রমেই যে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে আপনার।
Posted: 02:29 PM Jun 12, 2023Updated: 02:29 PM Jun 12, 2023

অরিঞ্জয় বোস: মাননীয় রাহুল দ্রাবিড় সমীপেষু,

Advertisement

বড় আশা করেই আমরা এসেছিলাম আপনার কাছে। আমরা যারা ক্রিকেট ভালবেসে বছরের পর বছর তাকিয়ে থেকেছি চিরহরিৎ ক্ষেত্রে, আর দেখেছি আপনিই সেই অসামান্য কৃষক, যাঁর আবাদে সোনা ফলেছে; তাঁরা জেনেছিলাম, পারলে আপনিই পারবেন। শাস্ত্রীয় জমানা যখন নিরুদ্দেশের উদ্দেশে, তখন আপনার আগমনী ঘোষণায় আমাদের মনে ছড়িয়ে পড়েছিল শরতের সোনা রোদ। উৎসবের ঘ্রাণ প্রাণ ভরিয়ে দিয়েছিল আমাদের। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, আপনিই আমাদের সেই মতি নন্দীর বেহুলার ভেলা, শত ঝঞ্ঝাতেও যা ডোবে না। বরং মৃত স্বপ্নকে ফিরিয়ে আনতে পারে জীবনের কাছে।

রাহুল দ্রাবিড় (Rahul Dravid), আপনি ছিলেন সেদিন আমাদের কাছে বিশ্বাস আর স্বপ্নের সমনাম।

ক্রিকেটীয় মেধার নিরিখে আপনার অবস্থান ঠিক কোথায়? তা আমাদের ছাপোষা ডাল-ভাতের জীবনে বুঝে ওঠা দায়। আমরা যারা গলি ক্রিকেট আর হাওয়াই চটির উইকেট, আমরা যারা বড়জোর পাড়া টুর্নামেন্ট থেকে বেপাড়ায় ক্যাম্বিস বলে মাস্তানি, তাঁরা দ্রাবিড়শাস্ত্র বুঝব আর কতটুকু! সে চেষ্টাও আমরা করি না তাই। শুধু জানি, আপনি সব উপেক্ষার নীরব জবাব দিতে জানেন আপনার ব্যাটের শিল্পে। মন্থর বলে যত কটূক্তি আপনি শুনেছেন, তার হয়তো হিসাব নেই। অথচ সেই শ্লথতাই যেদিন মহার্ঘ্য হয়ে উঠল আর আপনি হয়ে উঠলেন অভেদ্য প্রাচীর, সেদিন যেন সমস্ত অপমানের সপাট জবাব ফিরিয়ে দিলেন নিঃশব্দেই। আপনি আউট হলে শচীন তেণ্ডুলকর নামবেন বলে যে সব ময়দান আপনার প্রস্থানে করতালিতে ফেটে পড়ত, সেই সব ময়দান একদিন বুঝে গেল, একজন রাহুল দ্রাবিড় থাকা আর না-থাকা কী পার্থক্য গড়ে দেয়। আপনি তাই দিনে দিনে যেন হয়ে উঠলেন অকীর্তিত মানুষের জীবনের মুখর জয়গান।

[আরও পড়ুন: ১৫ অক্টোবর আহমেদাবাদে ভারত-পাক মহারণ! ইডেনেও বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলবেন বাবররা]

রাহুল দ্রাবিড়, আপনি ছিলেন সেদিন আমাদের মৌন মুখরতা, নৈশব্দের অহংকার।

আপনি তাই যখন কোচ হয়ে এলেন আমরা বড় স্বস্তি পেয়েছিলাম। শাস্ত্রী-কোহলির উত্থিত কলারে যে ঔদ্ধত্যের রং তা আমাদের পীড়িত করে তুলেছিল। আমরা চেয়েছিলাম কুসুমের মাস। আমরা চেয়েছিলাম ভারতীয় ক্রিকেট আবার হয়ে উঠুক বসন্তরঙিন, আর সে রং আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে না দিয়ে বরং মর্মে লাগুক। সন্দেহাতীত ভাবে, আপনার মেধা, প্রজ্ঞা, শৃঙ্খলা আর ক্রিকেটদর্শনই যে সেই স্বপ্নসফল দিন আনবে, এমনটা আমরা প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম। অথচ শেক্সপিয়ার সাহেব অমোঘ সত্যি, আর আমরা একদিন বুঝে গেলাম, ‘Our wills and fates do so contrary run/…Our thoughts our ours, their ends none of our own.” অর্থাৎ আপনি আমাদের ইচ্ছেনদীতে পানসি ভাসিয়ে যে পরিণতি উপহার দিলেন, তাতে পারাপার তো আর সম্ভবপর হয়ে উঠল না, বরং নৌকাডুবিই স্থির নিয়তি। অবশ্য একদিনে তো এই আশাহতের ক্রন্দন জাগেনি। আপনার অভিষেকের লাগি আমরা যারা অপেক্ষা করেছিলাম, তাঁরা তো সানন্দেই দেখলাম, নিউজিল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ৩-০-তে আপনি হেলায় হারিয়ে দিয়েছিলেন। পরপর কয়েকটি সিরিজ জেতায় আমরা ভেবেছিলাম, হে কমরেড, নবযুগ বোধহয় এনেই ফেললেন। কিন্তু হায়! বৃথা আশা মরিতে মরিতে একদিন মরিয়াই গেল। যখন দেখলাম, একের পর এক সিরিজে তীরে এসে তরী ডুবছে আপনার। ছোট ছোট ভুল সিদ্ধান্তে তছনছ হয়ে যায় দেশের ক্রিকেটের সাজানো বাগান। এখন তো আইসিসি ট্রফি না-জেতাই দস্তুর হয়ে উঠেছে। আপনি কিংবদন্তি, অথচ আপনার ধোঁয়াটে দৃষ্টিতে যেন অসহায় আর্তি। কোন চক্রব্যূহে আপনি আটকে পড়েছেন আমরা জানি না, তবে আপনাকে দেখে যেন মনে হয় যুদ্ধ তো দূরের কথা, গাণ্ডীব নামিয়ে রাখারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনি।

রাহুল দ্রাবিড়, এখন আপনি আমাদের কাছে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস, বিষাদযোগের অর্জুন।

আইসিসি ট্রফি জয়ের তাড়া নেই। এমন একটা কথা যে আপনার মুখে শুনব, আমরা কখনও ভাবিইনি। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ হারার পর তাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যে প্রশ্নটা আপনার দিকে ছুড়ে দিল, সেটিই করি- বিপক্ষের উপর চাপটা তো শুরুর দিন থেকে রাখার কথা। পাঁচ নম্বর দিনে এসে চাপের প্রকাশে নিজেরাই চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাব, এ নিশ্চয়ই কাম্য নয়। আপনি এর জবাব দিয়েছেন। কিন্তু সে জবাবে স্পষ্টই ধরা পড়ছে, একটা দর্শন থেকে আপনি যেন ক্রমশ সরে গিয়েছেন। যে দর্শন জয়ের। আপনি থাকতে ভারতীয় ব্যাটাররা টেকনিক্যাল ভুল করে উইকেট খোয়াবেন, এ সত্যি কেন আমরা মেনে নেব! কেন আমরা মেনে নেব, যে, একটা পার্টনারশিপ অবদি তৈরি হবে না বিশ্ব টেস্ট ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠতম মঞ্চে, যখন সেই টেস্টেরই শ্রেষ্ঠতম শিল্পী বসে আছেন নেপথ্যে! কেন আমরা মেনে নেব, যে আপনি রাহুল দ্রাবিড় স্বয়ং ম্যাচের শেষে এসে বলবেন, প্রস্তুতিতে গলদ ছিল! ঠিক এগুলোর জন্যই তো আপনাকে দরকার ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের। আপনার মৌনতা সমস্ত গলদের অনুমোদন হয়ে উঠলে, আপনি রাহুল দ্রাবিড় আর ব্যতিক্রম রইলেন কীসে!

রাহুল দ্রাবিড়, আপনি এখন আমাদের কাছে সেই প্রশ্ন যা বলে, পথিক পথ হারাইয়াছ!

[আরও পড়ুন: মনোনয়নের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব হাই কোর্টের, পিছোতে পারে পঞ্চায়েত ভোট]

ওভাল থেকে হাজার তিন কিলোমিটার দূরে আপনারই মতো আর এক কোচ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা দেখলাম পেপ গুয়ার্দিওলাকে। ম্যানচেস্টার সিটিকে প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতালেন তিনি। চূড়ান্ত সফল কোচ। তবু নিজের ভিতর জাগিয়ে রেখেছেন জয়ের অসামান্য আগুন। আর আপনি বলেছিলেন, ট্রফি জেতার তাড়া আপনার নেই। এই দুই পৃথিবীর ভিতর দর্শনের যে ফারাক, তাই-ই আজ আমাদের ক্লান্ত করছে। আর আমরা সেই আমাদের চিরপরিচিত রাহুল দ্রাবিড়কে ক্রমাগত ক্ষয়ে যেতে দেখে আহত, রক্তাক্ত হচ্ছি। অথচ, খিদের আগুনই তো জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে, ছুটিয়ে বেড়ায়। সে পেটের খিদে হোক কিংবা জয়ের খিদে। আপনি বোধহয় আর সেই খিদের কথা ভাবতে পারেন না। আর আমরা সেই খিদের ভিতরই বেঁচে থাকি। জীবনের খিদে, জয়ের খিদে। আপনাকে আর তাই সেই জ্যান্ত জীবনের জলছবিতে দেখতে পাই না কিছুতেই। কিংবদন্তির মালা আপনার প্রাপ্য, কিন্তু মালার ফুল যে জীবনবিচ্ছিন্ন, সে সত্য নিশ্চয়ই আপনি ভোলেননি। সম্মান আপনাকে জানাচ্ছি, হয়তো আপনার নীরব প্রস্থান সে সম্মান আরও ঘন করে তুলবে। আমরা চাইছি, আমাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবনের রাহুল দ্রাবিড় যেমন নীরবে সব কিছুর জবাব দিয়ে অর্হণীয় হয়ে উঠতেন, আজও সেরকমই থাকুন। তা যদি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে হয়, তবে তাই-ই সই! আপনি রাহুল দ্রাবিড় হয়েই থাকুন, হেরে যাওয়ার গানে আপনার গলা নাই-বা মেলালেন!

মাননীয় রাহুল দ্রাবিড়, আমাদের ভালবাসা নেবেন, হারিয়ে যাবেন না প্লিজ।

বিনীত,
ওভালে ভারতের দিকে যারা চোখ রেখেছিল, তাদের একজন।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement