২০২০-’২১ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১.৩৫ বিলিয়ন। আর মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন ১ লক্ষ ৯৪ টাকা। এটা অবশ্য বার্ষিক হিসাব। মাসিক হিসাবে ৮ হাজার ৩৪১ টাকা। তা না হয় হল, কিন্তু এর মানেটা কী? আপনি-আমি গড়ে প্রতি মাসে ৮ হাজার ৩৪১ টাকা উৎপাদন করি? তা-ই কী? একটু ভেবে দেখুন। লিখছেন দীপংকর দাশগুপ্ত
হে পাঠক, হে পাঠিকা। আসুন, চুপি চুপি একটু লেখাপড়া করি। আপনি কি ভারতের ‘জিডিপি’ বা মোট জাতীয় উৎপাদন সম্পর্কে অবগত? এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি যদি ‘না’ জবাব দেন, তবে সংখ্যাটি কী, আপনাকে বলি। কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে সেটি ছিল ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ১২৭.৪ বিলিয়ন টাকা। এই হিসাব কিন্তু ২০১১-’১২ সালের স্থির দ্রব্যমূল্য ধরে নিয়ে। অর্থাৎ, যদি ২০১১-’১২ সালের জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে ২০১৯-’২০ সালের দ্রব্যমূল্যে না-পৌঁছত, তবে জাতীয় উৎপাদন হত ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ১২৭.৪ বিলিয়ন টাকা। সংখ্যাটা সকলের কাছের স্বচ্ছ না-ও হতে পারে। কারণ, অধিকাংশ মানুষেরই ‘বিলিয়ন’ সম্পর্কে ধারণা কম। তবে ‘কোটি’ শব্দটা অনেকেই চিনি। তাই কোটির সাহায্য নিয়ে প্রথমেই বলি যে, ১ বিলিয়নের অর্থ ১০০ কোটি। একটু সহজবোধ্য হল কি?
যদি না-হয়, তবে আরও সরল করে দেখা যাক। ২০২০-’২১ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১.৩৫ বিলিয়ন। তাহলে মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন কত হল? এর উত্তর তো সকলেরই জানা। মাথাপিছু উৎপাদন ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ১২৭.৮ বিলিয়ন এবং ১.৩৫ বিলিয়নের ভাগফল। হাতের কাছে হিসাব যন্ত্র থাকলে দেখুন, উত্তর হল ১ লক্ষ ৯৪ টাকা। এটা অবশ্য বার্ষিক হিসাব। মাসিক হিসাব হল আবার ১২ দিয়ে ভাগ, সেই ভাগফল ৮ হাজার ৩৪১ টাকা। এটা অবশ্য গড় হিসাব। কাজেই সকলেরই গড় উৎপাদন ৮ হাজার ৩৪১ টাকা নয়। কারও বেশি, কারও কম। তা না হয় হল, কিন্তু এর মানেটা কী? আপনি-আমি গড়ে প্রতি মাসে ৮ হাজার ৩৪১ টাকা উৎপাদন করি?
[আরও পড়ুন: ‘জাগো বাংলা’য় আজ কী লিখলেন মমতা?]
একটু ভেবে দেখুন। টাকা উৎপাদন ব্যাপারটা কী? আমরা কেউই টাকাপয়সা তৈরি করি না। কেউ তৈরি করি জুতো, কেউ জামা, কেউ মোটর সাইকেল, কেউ জিবেগজা, কেউ সংগীত, কেউ পরনিন্দা- আরও কত কিছু হাবিজাবি। সব মিলিয়ে উৎপাদন কি তবে এই নানা ধরনের উৎপাদনের যোগফল? কিন্তু সাইকেল আর জিবেগজার যোগফল কী? এই যোগ তো করাই যায় না, তাই সাইকেলের বাজার মূল্য, জিবেগজার বাজার মূল্য, জুতোর বাজার মূল্য- এরকম সব কিছুর বাজার মূল্য দিয়ে তাদের উৎপাদনের অঙ্ককে গুণ করে আমরা প্রত্যেকটি পণ্যের উৎপাদিত পরিমাণের আর্থিক মূল্য পেতে পারি। আর, এই সমস্ত আর্থিক মূল্যের যোগফলও পাওয়া সম্ভব। কেবল সেই যোগফল ‘জিডিপি’ নয়।
এই রহস্যের কিনারা করার আগে আর্থিক মূল্য ব্যাপারটা সম্পর্কে সাবধান হওয়া প্রয়োজন। পর-পর দু’বছর হয়তো সাইকেল, জিবেগজা ইত্যাদির উৎপাদন অপরিবর্তিত রইল, কিন্তু তাদের আর্থিক মূল্য বেড়ে বা কমে গেল। তাহলে আর্থিক যোগফল বদলে যাবে, অথচ উৎপাদন বদলাবে না। এই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য একটি বিশেষ কোনও বছরের দ্রব্যমূল্যে প্রত্যেক বছরের উৎপাদন মাপা হয়। যেমন আমাদের ক্ষেত্রে আপাতত সেই বছরটা হল ২০১১-’১২। অবশ্য কয়েক বছর বাদে বাদে এই স্থির দ্রব্যমূল্যের বছরটিকে বদলে দেওয়া হয়, কিন্তু এখন সেই কথায় যাব না।
জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র সংজ্ঞা এখনও আমরা জানি না। ব্যাপারটা অবশ্য সরল। ধরুন, আপনি এমন এক অর্থনীতিতে বাস করেন যেখানে কেবল রসগোল্লা খাওয়া হয়। রসগোল্লা তৈরি করার জন্য আরও অনেক কিছু লাগে। রসগোল্লা উৎপাদকরা চিনি কিনছেন নন্দবাবুর দোকান থেকে, ছানা কিনছেন ভবদুলাল গোয়ালার কাছে এবং আরও যা-যা রসগোল্লার প্রয়োজনীয় উপাদান অন্যসব বিক্রেতা বা উৎপাদকের কাছে। এসব জড়ো করে হয়তো-বা ব্রজ ময়রাকে রসগোল্লা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হল। ধরা যাক, একটি রসগোল্লার মূল্য ৩০ টাকা। সেটি তৈরির জন্য চিনি, ছানা এবং অন্যান্য উপাদানের মোট দাম হল ২০ টাকা। অতএব, উপাদানের চেয়ে উৎপাদিত রসগোল্লার মূল্য ১০ টাকা বেশি। এই ১০ টাকার মধ্যে আবার ব্রজ ময়রার মজুরি বাবদ হয়তো ৪ টাকা ধরা আছে। একটি রসগোল্লা তৈরি করে উৎপাদকের লাভ হল তবে ৬ টাকা।
প্রশ্ন- এই ছোট্ট কাল্পনিক অর্থনীতিতে কত উৎপাদন হল? চিনি, ছানা ইত্যাদি উৎপাদনের মূল্য ২০ টাকা, রসগোল্লার মূল্য ৩০ টাকা। তবে মোট উৎপাদন কত? ২০+৩০= ৫০ টাকা? উত্তর- না। আপনার ৩০ টাকার রসগোল্লার ভিতরে ২০ টাকার উপাদানের মূল্য তো ধরাই আছে। আপনার কাজটা হল ২০ টাকার উপাদানের উপর ১০ টাকা মূল্য যুক্ত করে ৩০ টাকার রসগোল্লা বিক্রি করা। অর্থাৎ, পুরো ৩০ টাকার রসগোল্লা ব্রজ ময়রা তৈরি করেননি। ২০ টাকার উৎপাদন করেছে অন্য উৎপাদক, ব্রজর উৎপাদন ১০ টাকা। এবার প্রত্যেকের উৎপাদন যোগ করলে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩০ টাকা। আরও ভাবলে দেখবেন, চিনির উৎপাদকও আখের উৎপাদনের উপর যেটুকু মূল্য যুক্ত করেছেন সেটুকুই তাঁর উৎপাদন, ছানার উৎপাদকের বেলাতেও তাই। এইভাবে চলতে থাকলে, মোট উৎপাদনের সংজ্ঞা কী দাঁড়ায়? যত কিছু উৎপাদিত দ্রব্য বাজারে পাওয়া যায়, তার মোট আর্থিক মূল্য? অবশ্যই না। মোট জাতীয় উৎপাদন হল সমস্ত উৎপাদক যত মূল্য যুক্ত করছেন, তার যোগফল। ভেবে দেখুন, চিন থেকে আমদানি করা চিপ দিয়ে ভারতে যে কম্পিউটার তৈরি হচ্ছে, তার বাজার মূল্য যাই হোক না কেন, ভারতের উৎপাদন ওই চিপের দামটুকু বাজার মূল্য থেকে বাদ দিয়ে যা পড়ে থাকে, সেটুকুই। এমন না ভাবলে, একই উৎপাদনকে একাধিকবার যোগ করা হবে।
যাই হোক, আবার রসগোল্লায় ফিরি। যে ১০ টাকার মূল্য যুক্ত হয়েছে, তার মধ্যে ৪ টাকা হল ময়রার মজুরি আর ৬ টাকা হল দোকানদারের লাভজনিত আয়। অর্থাৎ ‘যুক্ত’ মূল্যের পুরোটাই কারও-না-কারও আয়। এবার সমস্ত অর্থনীতি-জুড়ে যদি মূল্য যুক্তকরণের সংখ্যা যোগ করে দেওয়া যায়, তবে আমরা কী পাব? কী আবার? জাতীয় আয়। আর ঠিক এখানেই জিডিপি-র অপর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। জিডিপি কেবল মাত্র উৎপাদনের পরিমাণ না, জাতীয় আয়েরও পরিমাণ। মানে, জিডিপি-ও যা, জাতীয় আয়ও তাই।
এবার গোড়াতে ফিরে যাই। বলেছিলাম গড়ে ২০২০-’২১-এ মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৮ হাজার ৩৪১ টাকা। এটা অন্যভাবেও বলা যেত। ২০২০-’২১-এ ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ওই একই সংখ্যা। যা বললাম, তার মধ্যে অবশ্য কারচুপি আছে। সেই ব্যাপারটা কী- পরের দিন বলব। ইতিমধ্যে একটা প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করতে পারেন। ‘আয়’ আর ‘মূল্য’ যুক্তকরণ যদি একই ব্যাপার হয়, তবে আয়কর আর মূল্য-যুক্ত করের মধ্যে তফাত কী?