ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল জয় নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদির জন্য সুখবর। কিন্তু কেন ট্রাম্প জিতলেন, কেন হিলারি ক্লিনটনের পর কমলা হ্যারিসও মহিলা হিসাবে মার্কিন পুরুষতন্ত্রর তৈরি ‘কাচের দেওয়াল’ ভাঙতে পারলেন না, সেই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা এবং চর্চা চলবে। লিখলেন সুমন ভট্টাচার্য।
ক) ‘প্রগতিশীল’ কাগজ বা ‘প্রগতিশীল’ চ্যানেল নির্বাচনের ভাগ্যনির্ধারণ করে দিতে পারে না। মানুষই ভোট দেয়, মানুষই ঠিক করে কে শাসন করবে।
খ) সেলিব্রিটিরা দুর্দান্ত ‘পারফর্মার’ হতে পারেন, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে তঁারা সাফল্য না-ও এনে দিতে পারেন। যদি লেডি গাগা, বিয়ন্সে বা টেলর সুইফ্ট-এর মতো মহাতারকা কমলা হ্যারিসকে জেতাতে না-পারেন, তাহলে আশপাশের ‘জোনাকি’-দের দেখে ‘স্বস্তি’ পাবেন না।
গ) ‘অতি বিপ্লবী’ হওয়া ভালো, কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে তা চলে না। দলের যে ‘অতি বিপ্লবী’, বা অতি বামেরা ‘পুলিশি ব্যবস্থাই তুলে দিতে হবে’, ‘দেশে আর পুলিশ থাকবে না’ বলে স্লোগান দিয়েছিলেন, তঁাদের হ্যারিস এড়ালেন বটে, কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের শেষ রক্ষা হল কই!
ঘ) যদি কোনও শিল্পপতি কোনও রাজনীতিককে ‘এনডোর্স’ না-করেন, যেমন: আমাজনের মালিক জেফ বেজোস, তঁার মালিকানাধীন ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে দিয়ে কমলা হ্যারিসের প্রার্থীপদকে ‘এনডোর্স’ করতে রাজি না হন, তাহলে বুঝবেন ‘মালিক’ হিসাবে তিনি অন্যরকমের ‘হাওয়া’ টের পাচ্ছেন। শিল্পপতি হিসাবে তিনি ওই রাজনীতির সঙ্গে স্বচ্ছন্দ নন। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে বুঝুন, মলে ঢুকে প্রতিবাদ আন্দোলন করতে দিচ্ছে না– এই নিয়ে শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে হুজ্জত বাধানো আসলে রাজনৈতিক বাস্তববোধের অভাব।
বুধবার, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল জয় থেকে আমি অন্তত যে প্রাথমিক উপাদানগুলি খুঁজে পেয়েছি, সেগুলি কি ‘অতি বিপ্লবী’ বা ‘প্রগতিশীল’-রা পড়তে পারলেন? খাস মার্কিন মুলুকের ভোটে, যে-দেশকে শিক্ষা, গণতন্ত্রর দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানো হয়, সেখানে যদি অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ‘আইকন’ ডোনাল্ড ট্রাম্প ১২০ বছরের রেকর্ডকে ভেঙে আবার হোয়াইট হাউসে ফিরে যেতে পারেন, তাহলে কি রাজনীতির ‘দেওয়াল লিখন’-টা পরিষ্কার নয়?
যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ, কর ফঁাকির অভিযোগে পরোয়ানা, আদালতে আত্মসমর্পণ– এমন কিছু কি বাকি ছিল যা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অতিক্রম করতে হয়নি? হোয়াইট হাউসে তঁার ফিরে আসা নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদির জন্য সুখবর। এ-যাবৎ জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাট প্রশাসন যেভাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সুরে সুর মিলিয়ে নয়াদিল্লিকে বিঁধে যাচ্ছিল, হয়তো তার থেকেও অব্যাহতি মিলবে। নির্বাচনের ঠিক আগে যেভাবে রিপাবলিকান প্রার্থী বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতন নিয়ে সরব হয়েছিলেন, তাতে আমাদের প্রতিবেশী দেশেও হয়তো টানাপোড়েন শুরু হতে পারে। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প যদি চিনের সঙ্গে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ চালিয়ে যান, তাতে ভারতের লাভ হতেও পারে।
কেন ট্রাম্প জিতলেন, কেন হিলারি ক্লিনটনের পর কমলা হ্যারিসও মহিলা হিসাবে মার্কিন পুরুষতন্ত্রর তৈরি ‘কাচের দেওয়াল’ ভাঙতে পারলেন না– সেই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা এবং চর্চা অবশ্যই চলতে থাকবে। এবং আমরা, ভারতীয়রা, বিশেষ করে যারা ডলারের টানে ততটা ‘প্রগতিশীল’ হতে পারিনি, হয়তো গর্ব করে বলতে পারব, ভারতের আমজনতা মহিলা রাজনীতিকদের যতটা সম্মান দেয়, রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে মেনে নেয়, ‘গণতন্ত্রর পীঠস্থান’ আমেরিকা এখনও সেটা শেখেনি। এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত, দক্ষিণ ভারতীয় এক মহিলার কন্যা হিসাবে কমলা হ্যারিসকেও বুঝতে হবে, রাজনীতিতে, কিংবা জীবনেও হয়তো দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। জো বাইডেনের তৈরি করা ‘ইজরায়েল নীতি’ ডেমোক্র্যাটদের থেকে মুসলিমদের মুখ ঘোরাতে বাধ্য করেছে। মিশিগান এবং পেনসিলভেনিয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই গুরুত্বপূর্ণ ‘সুইং স্টেট’, যে-দু’টি প্রদেশ ২০২০-তে জো বাইডেনকে জিতিয়েছিল, এবার সেখানে মুসলিমরা কমলা হ্যারিসের সমর্থনে ভোট দিতে যানইনি। আমেরিকায় বসবাসকারী মুসলিমদের এই নির্বাচনের আগে থেকে বক্তব্য ছিল, ২০২০-তে জো বাইডেনকে জিতিয়ে এনে তাদের কী লাভ হয়েছে? পশ্চিম এশিয়ায় মুসলিমদের রক্তঝরা কি বন্ধ হয়েছে? মুসলিম দুনিয়ার জনপ্রিয় চ্যানেল আল জাজিরা-য় মিশিগান এবং পেনসিলভেনিয়ার আরব মুসলিমদের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। তাদের সোজাসাপটা বক্তব্য ছিল, ‘ট্রাম্প খারাপ। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা আমাদের জন্য কী করল? ইজরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল?’
ট্রাম্প ‘খুল্লাম খুল্লা’। তিনি ‘আগ্রাসী’। অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ‘আইকন’। সেই কারণেই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক তঁার সমস্ত শক্তি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতাতে নেমে যান। যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ থেকে কর ফঁাকি দেওয়া– এখনকার বিশ্ব রাজনীতি যেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, এমনকী দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও যেসব বিষয় নিয়ে তুফান ওঠে, তার সবকিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য হোয়াইট হাউসে ফিরছেন মার্কিন মুলুকের এই ‘বিতর্কিত ধনকুবের’। কিন্তু, অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে ঠেকাতে ২০২০-তে জো বাইডেনের পিছনে যে ‘মহাজোট’ বা ‘রেনবো কোয়ালিশন’ তৈরি হয়েছিল, এবার তা কাজ করল না কেন? বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যারা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক লড়াই চালাতে চায়, সম্ভবত তাদের সবাইকেই এই প্রশ্নটা ভাবাবে। এবং ভাবানো উচিতও। কারণ, তা না-হলে ইউরোপ থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় যারা ট্রাম্পের জুতোতেই পা গলিয়ে চলতে চায়, সেই অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলি উৎসাহ পেয়ে যাবে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন, ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভাগ্য হোয়াইট হাউসের ‘বিদায়ী বাসিন্দা’ জো বাইডেনই ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিলেন। বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে-ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, কমলা হ্যারিস চার মাসের প্রচেষ্টায় সেটাকে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার উপরে কমলা হ্যারিস বা ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বের রাজনৈতিক লাইন নির্বাচনেও অনেক ‘দ্বিধা’ ছিল। একদিকে দলের ‘অতি বিপ্লবী’-রা, অন্যদিকে ‘ইহুদি লবি’, আর পাশাপাশি মুসলিম বা ‘প্রগতিশীল’-দের ‘অসন্তোষ’। আমেরিকার রাজনীতির নিরিখে ডেমোক্র্যাটরা যদি নিজেকে ‘মধ্যপন্থী’ হিসাবে দেখাতে চাইত, তাহলে তাতেও গুরুতর ছন্দপতন ছিল। কমলা হ্যারিসের পক্ষে শুধুমাত্র মহিলা আবেগ দিয়ে ডেমোক্র্যাট দলের এই বেহাল অবস্থাকে ঢাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেই কারণেই এবার শুধু হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরলেন না, মার্কিন পার্লামেন্টে দুই কক্ষ– সেনেট এবং হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ-ও রিপাবলিকানদের দখলে চলে গেল।
(মতামত নিজস্ব)