বিশ্বদীপ দে: কয়েকদিন আগের কথা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায় একটি সংবাদ। প্রয়াত হয়েছেন হায়দরাবাদের অষ্টম নিজাম মহরম জাহ বাহাদুর। সুদূর তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুলে তাঁর মৃত্যুর খবর নতুন করে মনে করিয়ে দিল ওসমান আলি খানের স্মৃতি। মহরমের ঠাকুরদা ছিলেন ওসমান। একদা তাঁকেই ধরা হত পৃথিবীর ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে। যিনি নাকি পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করতেন ১ হাজার কোটির হিরে! তাঁর মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে পাঁচ দশকেরও বেশি সময়। কিন্তু আজকের জেফ বেজোস, এলন মাস্ক কিংবা এদেশের আম্বানি-আদানিদের পৃথিবীতেও সম্পদের প্রাচুর্য ও বিস্ময়ে হতবাক করে রেখেছেন নবাব ওসমান। তিনিই হায়দরাবাদের শেষ নিজাম।
তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২৩৬ বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১৮ লক্ষ কোটি টাকা! পরাধীন ভারতের বুকের এই নবাব তাঁর বিত্তে টেক্কা দিয়েছিলেন সেই যুগের প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশদেরও। তা বলে তাঁকে কিন্তু হাতখোলা মানুষ ভেবে বসলে হবে না। মানুষটি কৃপণ হিসেবেও নাম কুড়িয়েছিলেন ১৯১১ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছর ধরে হায়দরাবাদ (Hyderabad) শাসন করা নবাব (Nizam)। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় যাঁরা ভারতের অংশ হতে চাননি, তাঁদের অন্যতম ছিলেন ওসমান। যাক সে অন্য গল্প। এই লেখা তাঁর ধনপ্রাচুর্য নিয়ে।
[আরও পড়ুন: ‘লাদাখে গণতন্ত্র নেই, আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে’, বিস্ফোরক দাবি সোনম ওয়াংচুকের]
ল্যারি কলিন্স ও ডমিনিক ল্যাপিয়ারের লেখা ‘ফ্রিডম অ্য়াট মিডনাইট’ গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে, ১৯৪৭ সালে নবাব ওসমানের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৭.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা। যা সেই সময় পৃথিবীর কোনও ব্যক্তির ছিল না। বলা হয়, তাঁর কাছে ছিল সোনার বাসন। এত পরিমাণে বাসন ছিল যে, একসঙ্গে ২০০ লোক বসে সেই বাসনে খাবার খেতে পারতেন। যদিও তিনি নিজে কিন্তু সোনার বা কোনও দামি বাসনে খাবার গ্রহণ করতেন না!
নবাবের বিত্তের মতো তাঁর কৃপণতার গপ্পোও মিথ হয়ে রয়েছে। বলা হয়, তিনি নাকি এমন কৃপণ ছিলেন, কোনও অতিথি তাঁর প্রাসাদে এলে তাঁদের ফেলে যাওয়া সিগারেটের টুকরোতেও নাকি সুখটান দিতেন তিনি। পোশাক আশাকও মোটেই নবাবসুলভ ছিল না। কুঁচকানো বহু ব্যবহৃত পোশাক চড়িয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। অথচ তাঁর বৈভব ছিল চোখ ধাঁধানো। রামচন্দ্র গুহর বিখ্যাত বই ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’-তেও এই আশ্চর্য বৈপরীত্যের কথা বলা হয়েছে। নবাবের গ্যারেজে একের পর এক গাড়ির লাইন। রোলস রয়েস গাড়ির ছড়াছড়ি। অন্তত ৫০টি রোলস রয়েসের কথা জানা যায়। অথচ এতগুলি গাড়ি থাকা সত্ত্বেও তিনি নাকি ১৯১৮ সালের মডেলের ভাঙাচোরা একটি গাড়ি নিয়ে পথে বেরোতেন।
[আরও পড়ুন: জিটিএ-তে ভাঙন, ত্রিপাক্ষিক চুক্তি থেকে বেরতে চেয়ে রাজ্য সরকারকে চিঠি মোর্চার]
বেশ সন্দেহবাতিকও ছিল তাঁর। সব সময় ভয় পেতেন, এই বুঝি কেউ বিষ খাইয়ে তাঁকে মেরে ফেলল। আর সেজন্য একজন লোক রাখা ছিল, যিনি তাঁর সব খাবার চেখে দেখতেন। এমন কোনও খাবার তাঁকে পরিবেশনই করা হত না, যেটা সেই ভদ্রলোক একবার চেখে দেখেছেন। এমন ধনসম্পদের প্রাচুর্যের উলটো দিকে তাঁর এই কৃপণতা ও সন্দেহবাতিক স্বভাবের গল্প মিলে তৈরি করেছে আশ্চর্য মিথ।
কিন্তু সন্দেহ নেই তাঁর ধনসম্পদের গল্পই সবচেয়ে বিখ্যাত। সেই গল্পেই ফেরা যাক। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত জ্যাকব হিরে। কোহিনূরের চেয়েও বড় এই হিরেকে নিছকই পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করতেন তিনি। যার দাম ১ হাজার কোটি টাকা। আসলে এই হিরেটাকে দু’চক্ষে সহ্য করতে পারতেন না ওসমানের বাবা মেহবুব আলি খান, হায়দরাবাদের ষষ্ঠ নিজাম। তিনি ওটাকে বলতেন ‘মনহুস হিরা’। অর্থাৎ অপয়া হিরে। তাই নিজের চটিতে ব্যবহার করতেন। পরে সেটাই খুলিয়ে পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন ওসমান।
ভাবা যায়! প্রায় ১৮৫ ক্যারেট অথবা ৪০ গ্রামের ওই হিরেই বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম পালিশ করা হিরে। যদিও সেটা নাকি বেশ সস্তাতেই কিনেছিলেন ওসমানের বাবা। তেমন ক্রেতা না মেলায় ২৫ লক্ষ টাকাতেই সেটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন হিরেটির আগের মালিক আলেকজান্ডার ম্যালকন জ্যাকব। এরপর তিনি কার্যতই কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে মারাও যান একেবারে হতদরিদ্র অবস্থায়। অনেক পরে, ১৯৯৫ সালে নিজামের ট্রাস্ট থেকে হিরেটি কিনে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এই মুহূর্তে দুর্মূল্য হিরেটি রয়েছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের এক ভল্টে, মুম্বইয়ে।
যাই হোক, নিজামের কথায় ফেরা যাক। তাঁর বিরুদ্ধে কৃপণতার যতই অভিযোগ থাক, তিনি কিন্তু দানধ্যান করতেন। বহু হিন্দু মন্দির নির্মাণে টাকা দিয়েছিলেন তিনি। তিরুপতি মন্দির থেকে সীতারামবাগ মন্দির- বহু মন্দিরেই বেশ মোটা টাকা অনুদান দিতেন নবাব। ছয়ের দশকে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় দেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সেই সময় অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়া দেশকে বাঁচাতে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে ৫ হাজার কেজি সোনা দান করেন নবাব। কিন্তু কৃপণতার স্বভাব অবশ্য তখনও ছিল। তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি সোনা দান করলেও যে সিন্দুকে সেগুলি পাঠানো হচ্ছে, সেগুলি দান করছেন না। সেগুলি যেন ফেরত পাঠানো হয়!
১৯৬৭ সালে ৮০ বছর বয়সে মৃত্যু হয় ওসমানের। কিন্তু থেকে গিয়েছে তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া মিথগুলি। মহরম জাহ বাহাদুরের মৃত্যু সেই ইতিহাস নতুন করে মনে করিয়ে দিল। সারা পৃথিবীর বিত্তবানদের নিয়ে কাহিনি কম নেই। সেই সব কাহিনির মধ্যে নবাব ওসমানের ঐশ্বর্যের ঝলকানিকে ভোলা কার্যতই অসম্ভব।