বিধাননগরে সি বি ব্লকের সেই গেস্ট হাউস। একটা সময়ে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রাণখোলা আড্ডা। শ্রোতা সঞ্জয় বিশ্বাস এবং কুণাল ঘোষের সামনে বাপি লাহিড়ীর অপূর্ব মূল্যায়ন করেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী।
তখন আমি বম্বেতে স্ট্রাগল করছি। আমি অভিনয়টা জানি, মোটামুটি সবাই বুঝছে। কিন্তু বাণিজ্যিক নায়ক? ঢুকব কী করে? তখন পরপর সফল নায়করা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া আমার শ্যামলা রংয়ের শরীর, অনেকেই বলছেন, ঠিক নায়ক নায়ক নয়। মাঝেমাঝে হতাশা আসছে। তখন ঠিক করলাম এমন একটা স্লট দিয়ে ঢুকব, যেটা ফাঁকা। যেখানে কেউ সেভাবে কাজ করেনি। এই ভাবনা থেকেই পাশ্চাত্য নাচ, ডিস্কো, শরীরে তুফান তোলার চর্চা। এটা একটা সাধনা। অস্বাভাবিক পরিশ্রম করেছি। এর মধ্যে দিয়ে আমি যেটা পারলাম, সেটা আর কেউ পারত না। সাধনা, চর্চা। কঠিন কাজ। কিন্তু তার চেয়েও কঠিন হল এই নাচটাকে পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজে বাণিজ্যিক ছবিতে নিয়ে আসা।
এটা ছিল বাঁচার লড়াই, অস্তিত্ব প্রমাণের লড়াই। ইন্ডাস্ট্রিতে নতুনত্বকে জিতিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ। আর এই সন্ধিক্ষণেই ‘জিমি’র জন্ম। মিঠুনের (Mithun Chakraborty) মধ্যে থেকে জন্ম নিল জিমি। আর ডিস্কোর উদ্দাম ছন্দে গোটা দেশ, এমনকি বিশ্বকে ভাসিয়ে দিয়ে জিমির প্রাণপ্রতিষ্ঠা করল বাপি লাহিড়ী (Bappi Lahiri), সবার বাপিদা। আমার নাচ আর বাপির গান, গোটা বম্বেতে শুরু হল নতুন যুগ। শুধু ‘ডিস্কো ডান্সার’ বা ‘ডান্স ডান্স’ দিয়ে মাপা যাবে না।
[আরও পড়ুন: ‘ও শিলিগুড়ি এলে কীভাবে যে সময় কেটে যেত…’, বাপি লাহিড়ীর স্মৃতিচারণায় মাসির বাড়ির সদস্যরা]
তখন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন হাওয়া, পশ্চিমী ছন্দ আর মিঠুন হওয়ার বাসনা। একটা ঘরানাই তৈরি হয়ে গেল। তারপর আমি আর বাপিদা ক’টা ছবিতে কাজ করেছি, সংখ্যাটা বড় কথা নয়। আসল কথা ট্রেন্ড সেটার আমরা। আমার নাচ ছাড়া ওর ওই গান জমত না। আবার ওই সুর না পেলে আমি নাচটা পারফর্ম করতাম কীভাবে। শুরুটাই তো আসল কথা। পরে যখন রাশিয়া বা অন্য দেশেও গিয়েছি, এমনকী এখানে আমার বাড়ির সামনে এসেছে বিদেশিরা, জিমিকে দেখার সে কী তাগিদ। এটাই অ্যাচিভমেন্ট। বাপি লাহিড়ী মানেই প্রাণোচ্ছ্বল উদ্দাম ছন্দ। তবে ওর ভিত্তিটা দারুণ মজবুত। ওর গান, চেহারা, পোশাক, গয়না দেখে যা মনে হয়, তার বাইরে ওর ক্লাসিকাল বেস, ট্র্যাজিক গানও দারুণ। আমি কখনও ওকে গায়কের নাম সুপারিশ করিনি। ও নিজেই ঠিক করেছে। নিজেও ফাটাফাটি গেয়ে দিয়েছে অনেক গান। এই বাঙালির নতুন ট্রেন্ড স্থাপনের যুদ্ধে ওই বাঙালির অবদানটাও মনে রাখার মত। মিঠুন নেচেছে। বাপ্পিদা নাচিয়েছে।
শুধু সিনেমা নয়, লাইভ শোতেও বাপি লাহিড়ী জমজমাট। ইউরোপ ট্যুরে গিয়েছিলাম । বাপিদা বাবা অপরেশ লাহিড়ীকেও নিয়ে গেছিল। পদ্মিনী, অনিতা রাজেরা ছিল। ওপেন স্টেজেও বাপি লাহিড়ী অনবদ্য। বম্বের কাছে কারজাতে আমার একটা ফার্ম হাউস ছিল। কাছেই বাপিদার ফার্ম হাউস। কিন্তু দুধটা নিতে বাপিদা, এমনকী ওর বাবাও আমার ফার্ম হাউসে আসত। বাপিদা একটা ট্যালেন্ট। সারা পৃথিবীর টাটকা সব গানের খবর রাখে। ওয়েস্টার্ন ব্যবহার করে। নতুন বহুরকম বাদ্যযন্ত্র এবং সাউন্ডের প্রয়োগ শুরু করেছিল, সেসব এখনও চালিয়ে যাচ্ছে।
[আরও পড়ুন: রাজ্যপালের বিরুদ্ধে একজোট বিরোধীরা, ১০ মার্চের পর অবিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকের সম্ভাবনা]
ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যালের সঙ্গে মিশিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে অবিরাম। ওর অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। ওর আরেকটা ভাল দিক, বম্বেতে কাজ করেও, নিজেও বহু স্ট্রাগল করেও, বাংলায় কাজ করে। বাংলা গান করে। বহু হিট গান ও বাংলায় দিয়েছে। আমার ধারণা ওর মাথায় এক্সপেরিমেন্ট চলে সবসময়। আরও অনেক কাজ ও করবে।
(মিঠুন এই মুহূর্তে বেঙ্গালুরুতে। কিন্তু বাপি লাহিড়ীর স্মৃতিচারণ মিঠুন ছাড়া অসম্পূর্ণ। দু’জনেই বম্বেতে এক ঘরানার প্রবর্তক ও প্রতীক। সেই প্রাণখোলা আড্ডায় বহু কথা বলতেন মিঠুন, রাতের পর রাত। সহস্র এক আরব্য রজনীর মতো। তার থেকে যতটুকু মনে আছে, বাপি লাহিড়ি সংক্রান্ত অংশ তুলে ধরা হল। একটি জায়গার নাম মনে না পড়ায়, তাঁর এক ঘনিষ্ঠকে ফোন করে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।)