গৌতম ব্রহ্ম: ছেড়েও ছাড়েনি। রেখে গিয়েছে দাঁত-নখের গভীর ক্ষত। যার জেরে করোনা (Corona Virus) থেকে সেরে ওঠার পরেও গড়ে প্রতি দু’জনের একজন শরীর-মনে বিবিধ উপসর্গ বয়ে চলেছেন। এঁরা ‘লং কোভিড’-এর শিকার। কেউ করোনাজয়ের এক বছর পরেও গন্ধহীনতায় ভুগছেন, অল্পেতেই হাঁফিয়ে যাচ্ছেন, কেউ হার্ট অ্যাটাকের শিকার হচ্ছেন। কারও উপর থাবা বসিয়েছে ডায়াবেটিস। কারও লিভার, কিডনির দফারফা।
বস্তুত ৫০% করোনাজয়ীর শরীরেই বিস্তর জটিলতা, যা কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার এক বছর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। করোনা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন যাঁরা, সমস্যটা তাঁদের মধ্যে বেশি প্রকট। ব্রিটেনের ৭৩,১৯৭ জন করোনাজয়ীর উপর সমীক্ষা চালিয়ে এমনই প্রবণতা দেখতে পেয়েছেন গবেষকরা। সম্প্রতি বিশ্ববন্দিত জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রের দাবি, ভুক্তভোগীদের ৪৯.৭% অন্তত একটা না একটা জটিলতার শিকার হচ্ছেন। কমবয়সীরাও বাদ নয়, ১৯-২৯ বছর বয়সীদের ২৭% লং কোভিডের গ্রাসে। ৩০-৩৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে জটিলতার আগ্রাসন বেশি, প্রায় ৩৭%। সবচেয়ে বেশি গড়বড় করছে কিডনি ও ফুসফুস। এছাড়া লিভারের গণ্ডগোল, অ্যানিমিয়া, কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া নিয়েও বহু করোনাজয়ী ফের হাসপাতালে ভরতি হচ্ছেন।
[আরও পড়ুন: করোনা কালে দীর্ঘদিন বন্ধ গ্রন্থাগার, কীটপতঙ্গের হাত থেকে বই বাঁচানোর আর্তি বইপ্রেমীদের]
সব মিলিয়ে সত্যি যেন রবিঠাকুরের ছোট গল্প, যা ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ।’ কলকাতাতেও বহু করোনাজয়ী নতুন করে অসুস্থ হচ্ছেন। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. যোগীরাজ রায়ের কথায়, ‘‘বেলেঘাটা আইডি’তে এঁদের জন্য আলাদা ক্লিনিক খোলা হয়েছে। প্রায় সতেরোশো রোগীর থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ‘পোস্ট-কোভিড কমপ্লিকেশন’ পাওয়া যাচ্ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কোমর্বিডিটি থাকলে বাড়তি সতর্কতা দরকার।’’
শুধু দেহে নয়, কোভিড থাবা বসাচ্ছে মনেও। অনেকে পাকাপাকি উদ্বেগের শিকার হয়েছেন। কারও আবার কয়েক দফায় প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। ‘বর্ডার লাইন’ ডায়াবেটিক রোগীরা বিপদসীমা পেরিয়ে ডায়াবেটিক হয়ে গিয়েছেন, এমন নজিরও অনেক রয়েছে। এমনটাই জানালেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. অনির্বাণ দলুই। তাঁর পর্যবেক্ষণ, শুধু কোভিড চিকিৎসা করলেই হবে না। কিংবা বাড়িতে সতেরা দিন আইসোলেশনে থাকলেই হবে না। এক বছর পর্যন্ত নিজের উপর নজরদারি চালাতে হবে। কিডনি, ফুসফুস, লিভার হার্টের অবস্থা জানতে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে টেস্ট করাতে হবে। সমস্যা অবশ্য অন্যত্র। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বাহ্যিক কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু টেস্ট করালে রিপোর্ট খারাপ আসছে। লিভার এনজাইম বেশি আসছে, ইসিজিতে গণ্ডগোল দেখা যাচ্ছে, ফুসফুসের সিটি স্ক্যান ফাইব্রোসিস আসছে, রক্তে মাত্রা বেড়েছে ক্রিয়েটিনিন ও শর্করার।
গাইডলাইন অনুযায়ী কোভিডমুক্তির দু’সপ্তাহের মধ্যে কিছু টেস্ট অবশ্যই করা উচিত। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কমপ্লিট হিমোগ্রাম (সিবিসি), ইসিজি সি রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন (সিআরপি), ডি ডাইমার, ফাস্টিং-ব্লাড সুগার, চেস্ট এক্সরে, লিভার ফাংশন টেস্ট, কিডনি ফাংশন টেস্ট। তাছাড়া অন্য কোনও ইপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে তারও পরীক্ষা করতে হবে। রিপোর্টে কোনও গরমিল এলে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হবে।