রাজধানীর হাল৷ রাজনীতির চাল৷ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়মিত কলম সৌম্যদর্শন৷
‘ভারতীয়’ মানেই ‘হিন্দু’ নয়৷ কিন্তু প্লেনের মেঘবালিকাদের তা কে বোঝাবে? বছর পঁচিশ আগে নিউ ইয়র্ক থেকে ব্রাজিল যাওয়ার পথে এয়ারহোস্টেসকে বোঝাতে পারিনি, আমি ‘হিন্দু’ কিন্তু ‘নন-ভেজ’ খাই৷ ক’দিন আগে মিশর থেকে ফেরার সময়ও একই অভিজ্ঞতা৷ ‘হিন্দু মিল’ যে ভারতীয়ত্বর একমাত্র স্মারক নয়, তা স্পষ্ট করতে টুর অপারেটরদেরও প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিতে হবে৷
হঠাত্ কেন এই কাহিনি সাতকাহন করে বলতে চলেছি, কেনই-বা ঘটনাটি এখন মনে পড়ল তা পরে বলছি৷ আগে অভিজ্ঞতার কথা বলি৷
এটাও বলি, আমার মতো হাজার-হাজার কিংবা লাখ-লাখ ভারতীয় নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও সময় এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন৷ তাঁদের মনেও হয়তো আমার মতো প্রশ্ন জেগেছে৷ অথচ সেই প্রশ্নের কোনও মীমাংসা আজও হয়নি৷
পঁচিশ বছর আগে একবার নিউ ইয়র্ক থেকে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো যাচ্ছি৷ আমাদের এয়ার ইন্ডিয়ার মতো ব্রাজিলের বারিগ এয়ারওয়েজের বিমানে চেপেছি সন্ধেবেলায়৷ ডিনার সার্ভ করা হবে৷ মেঘবালিকারা ট্রলি নিয়ে হাজির৷ এমন সময় দেখি একজন আমার জন্য খাবার নিয়ে এলেন৷ ট্রের গায়ে লেখা ‘হিন্দু’৷
‘হিন্দু’? লেখাটা দেখে আমার বিস্মিত হওয়ার পালা৷ খুব ধীরে খাবারের মোড়কগুলো খুললাম৷ ফ্রায়েড রাইস, পরোটা, দু’টুকরো পনির, সে সবজি, স্যালাড, মিষ্টি এবং আরও কিছু যা এখন আর মনে নেই৷ প্রতিটা খাবার-আঁটা ফয়েলের গায়েই ‘হিন্দু’ লেখাটা আমায় বিরক্ত করল৷ আমি মেঘবালিকাকে ডাকলাম৷ আমাকে আশ্চর্য হতে দেখে সে তার স্বল্প জানা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ‘ইউ ইন্ডিয়ান’? আমি হ্যাঁ বলতে সে কাঁধ দু’টো সামান্য তুলে বলল, ‘হিন্দু ফুড ফর ইন্ডিয়ানস৷’ তারপর মুখের ভঙ্গিটা এমন করল যেন, এই খাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও গতি নেই৷
আমি তাকে বললাম, ‘শোনো হে বালিকা, আমি ইন্ডিয়ান৷ আমি হিন্দুও৷ কিন্তু তাই বলে আমি নিরামিষাশী নই৷ ভারতবাসী মানেই তারা হিন্দু এবং তারা নিরামিষাশী এই ধারণাটা ভুল৷ তোমাদের মতো আমিও নানা ধরনের মাছ-মাংস-ডিম খাই৷ আমার এই ফুড প্রেফারেন্স টিকিট বুক করার সময় জানানোও হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও তুমি আমাকে এই ভেজিটেরিয়ান ফুড সার্ভ করছ! দুঃখিত, এটা আমি গ্রহণ করছি না৷’
আমি দু’হাতে খাবারের ট্রে-টা তুলে ধরে মেয়েটির চোখে চোখ রাখলাম৷ তার দৃষ্টিতে বিহ্বলতা ও বিস্ময়৷
মেয়েটি ট্রে নিয়ে চলে গেল এবং আর একজনকে ডেকে আনল যার ইংরেজি জ্ঞান কিঞ্চিত্ বেশি৷ আমার যুক্তি শুনে ঠোঁট উল্টে সে বলল, তা হলে আমি তাদের ট্রলি থেকে আমার পছন্দমতো খাবার খেতে পারি৷ নো ইস্যুজ৷
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পঁচিশ বছরেরও অনেক আগে এ-দেশের অনেক মানুষের নিশ্চয়ই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ তাঁরা কে কী করেছেন জানি না৷ আর, পরেও যে হচ্ছে, সে তো আমিই জানি৷ সে-জন্যই তো এই সাতকাহন৷
এই সেদিন সপরিবার মিশর বেড়িয়ে ফিরছি৷ ফেরার রাতে ফের সেই ‘হিন্দু মিল’৷ এবার আর প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হল না৷ ইজিপ্ট এয়ার অর্ধেকের বেশি খালি৷ কায়রো টু মুম্বই মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার ফ্লাইট৷ কোনওরকমে খাবার সার্ভ করেই তারা খালাস৷ ‘হিন্দু মিল’-এর ব্যাপারটাই যে গোলমেলে, তা বুঝিয়েও কোনও লাভ হল না৷ মিশরীয় মেঘবালিকাদের ইংরেজি জ্ঞান এতই কম৷ কিন্তু তারা যেটা কোনওরকমে বোঝানোর চেষ্টা করল, সেটাও অবাক করার মতো৷ তাদের কাছে নাকি খাবারই বাড়ন্ত! অগত্যা…৷
কাজে-অকাজে বিদেশ যেতে হয়৷ সবসময়েই যে এই ‘হিন্দু মিলের’ চক্করে পড়তে হয় তা নয়৷ অধিকাংশ ফ্লাইটেই ‘ভেজ’, ‘নন-ভেজ অপশন’ থাকে৷ মেঘবালিকারা জানতে চায়৷ যার যেমন ইচ্ছা ও প্রয়োজন তেমন খাবে৷ কিন্তু ভারতীয় মানেই হিন্দু এবং হিন্দু মানেই নিরামিষ খাদ্য, এই ধারণাটা কেন যেন কারও-কারও মনে গেড়ে বসেছে৷ না হলে টিকিট বুক করার সময় অপশন দিলেও কেন ‘হিন্দু’ লেখা ট্রে আসবে? আমার আপত্তিটা এখানেই৷
এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমাদের দেশে কিছুকাল ধরে গরু নিয়ে যে বাড়াবাড়িটা শুরু হয়েছে, সেই ঘটনাগুলো মনে পড়ল৷ আরও মনে হল ইদের দিন দশেক আগে হরিয়ানা-সহ দেশের কোনও কোনও জায়গায় যা ঘটে গেল সেই কারণে৷
এক সর্বভারতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবি দেখলাম ও তার লাগোয়া প্রতিবেদনটা পড়লাম৷ ছবিটা এইরকম, প্রশস্ত এক সড়কের ধারে সার-সার পলিথিনের ফাঁকা ছাউনি৷ ছাউনির নীচে একটা চৌকি ও খানকয়েক চেয়ার৷ সব খালি৷ হরিয়ানার মেওয়াট জেলার দোহায় দিল্লি-আলওয়ার হাইওয়ের ওপর এই ছাউনিগুলো স্থানীয়দের বিরিয়ানি স্টল৷ মুসলমান-প্রধান এই অঞ্চলে যাতায়াতের পথে মানুষ গাড়ি থামিয়ে এইসব স্টলে একটু জিরোয়৷ বিরিয়ানি খায় অথবা প্যাক করে চলে যায়৷ রাজ্যে বিজেপি আসার আগে গরু নিয়ে বাড়াবাড়ি যখন ছিল না, তখন এইসব স্টলে সব ধরনের বিরিয়ানি বিক্রি হত৷ গরু-মোষ বা চিকেন৷ গরিব মানুষের সস্তার পেট-ভরা প্রোটিন সর্বস্ব খাবার৷ বিজেপি ও মোদি-জমানায় গোহত্যা নিয়ে যা শুরু হয়েছে, তাতে অতি-উৎসাহীদের নজরদারিতে পেটে কিল পড়েছে এই মানুষজনের৷ কীরকম, তা নিয়েই ওই সচিত্র প্রতিবেদন৷ সেটা শুরু হচ্ছে এইভাবে, ‘এই, বিরিয়ানির হাঁড়ি সরিয়ে ফেল৷’ হতবাক লোকগুলো বলে বোঝাতে পারছে না, বিরিয়ানিতে গরুর মাংস নেই৷ স্বঘোষিত অভিভাবকরা সেই আর্জিতে কান না দিয়ে বলল, ‘ওসব পরে দেখা যাবে৷ আগে হাঁড়ি হটা৷’
একমাস আগেও এই সড়কের ওপর কুড়িটা বিরিয়ানি স্টল ছিল৷ এখন একটাও নেই৷ কেননা, মোট পঁচিশবার বিরিয়ানি তছনছ করে মাংস নিয়ে গিয়েছে রাজ্যের পুলিশ৷ পরীক্ষা করে দেখবে তা গরুর মাংস কি না৷ এমনকী, মুরগির মাংসও গরু ভেবে পরীক্ষাগারে গিয়েছে৷ পেটে হাত বিক্রেতাদের৷ অথচ পুলিশ কিছুতেই বলছে না, অভিযোগটা কার বা কাদের এবং মাংস পরীক্ষায় কী বেরল৷ কিন্তু নিট রেজাল্ট? বিরিয়ানি স্টলগুলো খাঁ খাঁ করছে৷
ভারত তো আর উত্তর কোরিয়া বা চিন নয়, তাই এই জাতীয় খবর ও গোহত্যা বন্ধ করে গোমাতাকে রক্ষার এই ধরনের উদ্যোগের খবর সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ে৷ বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো ভারত সম্পর্কিত প্রতিবেদনের সময় রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলির পরিচয় তাদের মতো করে নিয়মিত দিয়ে থাকে, যাতে তাদের পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হয়৷ যেমন, বিজেপির পরিচয় দেয় ‘রাইট উইং হিন্দু আউটফিট’ বলে, কিংবা তাদের শাখা সংগঠকদের ‘হিন্দু লিডার’৷ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদিরও পরিচয় ছিল ‘প্রো-হিন্দু লিডার’ বলে৷ এসব তো বটেই, এর বাইরেও নানান কারণে ‘ইন্ডিয়া’ ও ‘হিন্দু’ কীভাবে যেন সমার্থক হয়ে গিয়েছে৷ সেটা ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’-এর জন্য কতটা, কতটা বা ‘হিন্দুস্থান-পাকিস্তান’-এর কারণে, বলা মুশকিল৷ তবে এটুকু বলা যায়, সংবিধানে ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’ লেখা রয়েছে ‘ইন্ডিয়ানস আর হিন্দুজ’ নয়৷
এ-দেশের একশো পঁচিশ কোটি মানুষের অধিকাংশই এখনও ‘ভারতবাসী’ হলেও তারা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক দিক থেকে ‘ইন্ডিয়ান’দের দ্বারা শাসিত, শোষিত ও পরিচালিত৷ দশ বছর অন্তর এ-দেশে জনগণনা হয়ে থাকে৷ তা থেকে পুরুষ-নারীর শতাংশ জানতে পারি, জাত-পাত বেরয়, শহুরে-গ্রামবাসীদের অনুপাত জানা যায়, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের হার বোঝা যায়, ধনী-দরিদ্রের সংখ্যা বুঝতে পারি, জানা যায় আরও কত কী৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত জানা যায়নি, এই একশো পঁচিশ কোটির মধ্যে কতজন ‘শুদ্ধ শাকাহারী’ আর কতজনের মাছ-মাংস-ডিমে আসক্তি রয়েছে৷ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণদের মধ্যে এখনও এই ধরনের ছোঁয়াছুঁয়ি থাকলেও পূর্ব প্রান্তে তা অশ্রূত৷ কাজের সুবাদে দিল্লি চলে আসার পর প্রথম-প্রথম কোনও-কোনও সরযূপাড়ি বা কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতেন, ‘বাঙালের (বঙ্গদেশ অর্থে) ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব মাছ-মাংসে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে৷’ আমি হাসতে-হাসতে তাঁদের বলতাম, ‘প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য তোমাদেরও এই পরিশোধন বড় প্রয়োজন৷’
ভারতীয় মানেই ‘হিন্দু’ এবং সে-জন্য বিমানে নিরামিষ খাদ্য বাধ্যতামূলক, এই ধারণাটার বদল কারা, কীভাবে করতে পারে বলা মুশকিল৷ তবে হওয়াটা জরুরি৷ ভারতীয় ট্যুর অপারেটররা এক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা নিতে পারেন৷ ভ্রান্ত ধারণার অবসানে তাঁদেরই এগনো উচিত৷ ভারত বহু ধর্ম-বর্ণ-জাতের সমাহার৷ ভারত বহুত্ববাদী একটা দেশ৷ এই বহুত্ববাদীতাই তার মূল শক্তি৷ আমাদের সংবিধানের মূল মন্ত্রও তো তাই৷ সেই কোন ছোট থেকে এই ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি’র কথা শুনে আসছি৷ অথচ আজ যখন দেশের কোণে-কোণে (এবং বিদেশের অন্তরীক্ষে) মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ওপর অযথা খাঁড়ার কোপ পড়তে দেখি, তখন কেন যেন বড় বিপন্ন বোধ করি৷ শুধু মনে হয়, অহেতুক আমরা নিজেরাই নিজেদের দুর্বল করে তোলার পথ প্রশস্ত করছি৷ আর মনে পড়ে আদ্যিকালের সেই গল্পটা৷ একটা কাঠি পট করে ভেঙে ফেলা সহজ৷ দশটা কাঠি একসঙ্গে করলে শক্তিক্ষয়ই হয়৷ কাঠিগুচ্ছ অটুটই থাকে৷
The post ‘পদে পদে মিল খুঁজি, খুঁজে দেখি হিন্দু’ appeared first on Sangbad Pratidin.