সরোজ দরবার: অরণ্যের সমস্যা, সেখানে স্বাভাবিকভাবেও আগুন লাগে। আর, মানুষের সুবিধা যে – সে বুদ্ধিমান, এবং প্রয়োজনে সেই বুদ্ধিকে চতুরতার সঙ্গে মিশিয়ে শয়তানে পরিণত হতে তাকে দু-দণ্ড ভাবতে হয় না, কারণ তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তাকে অনেকাংশেই সে-অনুমোদন দেয়। ফলে, খাণ্ডবদহন যখন হচ্ছিল, আমরা জানি, দুই বীরপুরুষ পাহারা দিচ্ছিলেন, একটিও বন্যপ্রাণী যাতে বাইরে যেতে না পারে। অগ্নির ক্ষুধামন্দ বলে কথা! যজ্ঞের ঘি আর কাঁহাতক খাওয়া যায়! অতএব, চমৎকার ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এইবার। সেই ইঁদুর ধরার কাজে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন দুই পুরুষ, যাঁদের আমাদের মহাকাব্য বীরশ্রেষ্ঠ ও ধর্ম সংস্থাপনার জন্য পুজো অর্পণ করেছে। আর, আজ যখন আমাজন জ্বলছে, আমরাও পাহারা দিচ্ছি যাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের প্রতিবাদ ফসকে না যায়। নিশ্চিত আগামীর কোনও মহাকাব্য – যদি তা রচনার জন্য আদৌ মানুষ বেঁচে থাকে – আমাদেরও এই ‘ধর্ম প্রতিষ্ঠা’র ক্রুসেডার হিসেবে পুজো-ই করবে।
[আরও পড়ুন: ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ আমাজনকে বাঁচাতে উদ্যোগী বলিভিয়া, সুপার ট্যাঙ্কার দিয়ে বিমান থেকে জল]
তা ‘ধর্ম’ সেদিন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বটে। তবে, সমস্ত গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভের পাশাপাশিই তো কিছু মাইক্রো ন্যারেটিভ থাকে। পরবর্তীকাল বিনির্মাণে যা উঠে আসে। যেমন, আমরা জেনেছি যে, তথাকথিত আর্যেতর নাগজাতিকে পরাস্ত করতে খাণ্ডবদহন সে-সময় কেমন জরুরি হয়ে পড়েছিল। সে বিবাদ পাণ্ডবদের স্বর্গারোহণের পরেও চলেছিল। কাজেই, সেদিন কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে, বা বলা ভালো, কোন দখলের রাজনীতিকে জয়ী করতে দুই বীর রত হয়েছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়। উল্লেখ্য, এখন প্রায় আমরা সকলেই শুনেছি আমাজনের আগুন ‘ম্যান মেড’। আন্তর্জাতিক স্তরে এ-নিয়ে বিস্তর লেখালিখি চলছে। বনে তো আগুন লাগেই। ফলে কোনটা লাগল আর কোনটা লাগানো হল, তার প্রভেদ করা মুশকিল। কিন্তু বারবার চোখে আঙুল দিলে চোখ খারাপ করতে পারে, দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ বদলায় না। অর্থাৎ, একটু চোখ পালটে দেখাটাই এখন জরুরি, এবং সে-ভাবেই আমরা দেখি, যে-শাসকের অধীনে এখন আমাজনের অরণ্যের বেশিরভাগটাই, তাঁর নীতি খুব যে পরিবেশপ্রিয়, এমন কথা অতিবড় ভক্তও বলবেন না। তা ছাড়া অরণ্যের অধিকার কার, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব চিরন্তন। অরণ্যবাসী নাকি কৃষিজীবী নাকি মুনাফালোভী কর্পোরেট – কে অরণ্যকে পাবে, তা নিয়ে সরকার নিজেই যখন আসরে অবতীর্ণ, তখন আগুন লাগল না লাগানো হল, তা আমরা কিঞ্চিৎ বুঝতে পারি বটে। কিন্তু কিছু করতে পারি না। ফলে ঘটে অরণ্যের গণহত্যা। মানুষের সমাজে যা ‘জেনোসাইড’, ইকোসিস্টেম ধ্বংসের ক্ষেত্রে তাই-ই ‘ইকোসাইড’। লণ্ডনবাসী জনৈক Stefan Simanowitz-এর চয়ন করা এই শব্দবন্ধটিই প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে অরণ্য-ধ্বংসের এই ভয়াবহতাকে যথার্থ রূপ দিতে পারে। আমরা জানি, আমরা কী করছি। যেমন জার্মান জানত। তবু আমরা অরণ্যে আগুন সংযোগ করি, কেন-না আমরা এ-ও জানি, আধিপত্যের ইতিহাসে খাণ্ডবদহন আমাদের ভিত্তি, ইকোসাইড আমাদের ভবিষ্যৎ।
[আরও পড়ুন: আগুন নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ, সমালোচনার মুখে আমাজনে সেনা পাঠাল ব্রাজিল]
কিন্তু ব্রাজিলের বন পুড়লে আমাদের কী! অক্সিজেনের হিসেব-নিকেশের কথা বলছি না। ব্রাজিলের বহু মানুষ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, এবং তা-নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ক্রমাগত লিখে চলেছে, তা-নিয়েও আমাদের কিছু বলার নেই। কারণ, আমাদের তো আপাতত শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না। তা ছাড়া, পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের বনভূমি তো কমেইনি, উলটে কিঞ্চিৎ বেড়েইছে। অতএব, স্বস্তি। আমাদের তথ্য আছে, কিন্তু সেই তথ্য কীভাবে ‘প্রসেসড’ করে ডেটা তৈরি হয়েছে, তা খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন-ইচ্ছে কোনোটাই তেমন নেই। যদিও পরিবেশ নিয়ে খবরাখবর বলতে, ‘কবে বৃষ্টি আসবে’ আর ‘ক-ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়েছে’ এই গড় জানার ইচ্ছে থেকে বেরিয়ে আমরা এখন খোলা জলকলের মুখ বন্ধ করা অবধি পৌঁছেছি। তবু ততটাও কি খেয়াল করেছি যে, বনভূমি পরিমাপের অঙ্কে কীভাবে সূক্ষ্ম ফারাক আনা হয়েছে। ঘন জঙ্গল ধীরে ধীরে মুছে দেওয়া হচ্ছে। আর বৃক্ষরোপণ বা অনেক কম ঘনত্বের বনভূমিকে হিসেবের মধ্যে অন্তর্গত করে নিয়ে মোট হিসেব যে-ভাবে বাড়ছে, তা নিয়ে লেখালিখি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু, আমরা–জনসাধারণ তা নিয়ে তেমন ভাবিত হয়েছি কি? আমরা প্রতিবাদ বা আন্দোলনে নেমেছি? উল্লেখ থাক, আমাদের জানার বাইরে হয়তো অনেকেই অনেক প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু বলতে চাইছি, যে গণ-সচেতনতা এ-ব্যাপারে বৃহত্তর আন্দোলন সংঘটিত করতে পারে, তা কোথায়? ফলে বুলেট ট্রেনের জন্য গাছ কাটা হবে শুনলে আমরা বেশ দুঃখ পাই। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অরণ্য ধ্বংস হবে শুনলেও বিব্রত হই। আবার তা কমিয়ে নেওয়া হলে বা রদ করা হলে চুপচাপ হয়ে যাই। সেই নীরবতার মধ্য দিয়েই একটু একটু করে অরণ্য মুছে দেওয়া হয়। পাহাড় ভেঙে ফেলা হয়। নদী শুকিয়ে মরে যায়। আমরা, এ-সব যতদিনে জানি, ততদিনে আগুন লেগে গেছে। তাকে আর থামানো যায় না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের কাছে খুবই পরিচিত একটা শব্দ ‘বোলসোনারিজম’। ব্রাজিলের শাসককে লক্ষ্য করে রচিত এই শব্দ আসলে একবজ্ঞা, কর্পোরেটপ্রিয় মানসিকতাকে এককথায় প্রকাশ করে দেয়। আমাজনের আগুনের জন্য সেই বোলসোনারিজমকে-ই দায়ী করছে বিশ্ব। কথা হল, এই মানসিকতা তো আমাদেরও খুব চেনা। নামটাই যা আলাদা হতে পারে। ফলে, অরণ্য-ধ্বংসের ইতরপনা তথা ‘ইকোসাইড’ কি আমাদের এখানে হবে না বা হচ্ছে না, তা-তো নয়। হয়তো অগ্নিগ্রাসের বদলে অন্য পদ্ধতিতে। অন্য প্রক্রিয়ায়। তাতে বিপর্যয় কিছু কমে না। আমাজনের আগুন তাই আমাদের মূল একটা প্রশ্নের দিকে ঠেলে দেয়। পরিবেশের দফারফা হলে মানবসভ্যতাও বিলুপ্ত হবে। তবে কি যে-আগুন সভ্যতার অন্যতম আবিষ্কার ছিল, তাই-ই সভ্যতাকে পোড়ানোর দায়িত্বটুকুও পালন করবে? সবই নির্ভর করছে ওই বোলসোনারিজম বা নামভেদে অন্য ইজম এবং আমাদের সচেতনতা ও গণ-প্রতিবাদের উপর। অসম লুডোখেলা। তবু সাপ-মই করতে করতে যে জিতবে, সভ্যতার নিয়তি যে সে-দিকেই ঢলবে, এ নিয়ে আজ আর কোনও সন্দেহ-ই নেই।
The post খাণ্ডবদহন থেকে ‘ইকোসাইড’, প্রকৃতির বিনিময়ে চলছে দখলের রাজনীতি appeared first on Sangbad Pratidin.