বিশ্বদীপ দে: গত শতকের আটের দশক বা নয়ের দশকের শুরুর দিকের সময়টা যেন আজ অনেকটাই পিছনে সরে গিয়েছে। বিশ্বায়ন-পূর্ব সেই শান্ত সময়টায় রোমাঞ্চ খুঁজতে মানুষ যাদের দ্বারস্থ হতেন তাঁদের অন্যতম ছিল র্যামসে ব্রাদার্স। মাঝের তিন দশকে পৃথিবী যতই বদলে যাক, আজও সেই সময়ের ভৌতিক ছবিগুলিকে ভোলা যায়নি। তাদের তৈরি কম বাজেট, সস্তা প্লটের ছবিগুলি সদ্য শুরু হওয়া ভিডিও যুগে বহু মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিত। আজ ‘কাল্ট’ হয়ে গিয়েছে ‘পুরানা মন্দির’ (১৯৮৪), ‘ভিরানা’র (১৯৮৮) মতো ছবিগুলি। আর এই ছবিগুলি নিয়ে আলোচনা শুরু করলেই মনে পড়ে যায় একটা মুখ। যে মুখ দেখলে দিনের আলোতেও বুক ছ্যাঁৎ করে উঠবে। তিনি অজয় আগরওয়াল। পিতৃদত্ত নাম অনিরুদ্ধ। দীর্ঘাকায় মানুষটির মুখাবয়ব ছিল এমনই ভয়াবহ, মেকআপ ছাড়াও যে মুখের দিকে তাকালে মানুষ শিউরে উঠত। ওই মুখই যেন আটের দশকে তৈরি হওয়া সেক্স ও ভায়োলেন্সের সঙ্গে হরর মিশিয়ে তৈরি হওয়া দ্বিতীয় শ্রেণির বলিউড ছবিগুলির অন্যতম ইউএসপি।
এই অজয় থুড়ি অনিরুদ্ধর রুপোলি পর্দায় আসা ও পাবলিকের হৃদয়ে জগঝম্প জাগিয়ে তুলে ‘মনস্টার’ হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠার গল্পটাও কিন্তু কম চমকপ্রদ নয়। আসলে র্যামসে ব্রাদার্সই (Ramsay brothers) এদেশের ছবিতে ‘খাঁটি’ হরর উপাদান নিয়ে এসেছিল। পরবর্তী সময়ে রামগোপাল ভার্মা, বিক্রম ভাটরা সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটানোয় পূর্বসূরির কাছে তাঁরাও যেন ম্লান। আর এই আগমার্কা ভূতূড়ে বলিউড ছবির এক প্রতীকী মুখ ছিলেন অনিরুদ্ধ। তাঁর দৈর্ঘ্যও ছিল একটা বিরাট ফ্যাক্টর। সাধারণ্যে একটা ধারণা ছিল, এই মানুষটির দৈর্ঘ্য সাত-আট ফুট হবেই। কিন্তু খোদ অভিনেতা এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠেন। শ্যামা দাশগুপ্তের লেখা ‘ডোন্ট ডিসটার্ব দ্য ডেড দ্য স্টোরি অফ দ্য র্যামসে ব্রাদার্স’ বইয়ে পাচ্ছি সেই প্রসঙ্গ। লেখিকাকে তিনি জানিয়েছিলেন, ”আমি ছয় চার। বড়জোর ছয় পাঁচ। এর বেশি নয়। আমি লম্বা হলেও আহামরি লম্বা নই। আসলে এসবই গাঙ্গু র্যামসের ক্যামেরার কারসাজি। উনি এমন ভাবে শট নিতেন আমাকে অতিকায় দেখাত।”
[আরও পড়ুন: ‘রাখির চক্করে পড়েই ওর সর্বনাশ!’ আদিলকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় শার্লিন চোপড়া]
সেই সঙ্গে অনিরুদ্ধ নিজেই জানাচ্ছেন, ”আমার মুখটাই এমন ছিল ওদের খুব একটা মেকআপ করারও প্রয়োজন পড়ত না। আমার মুখ… আমি সকলের কাছেই হয়ে উঠেছিলাম আতঙ্ক।”একই কথা শোনা যায় শ্যাম র্যামসের মুখেও, ”ওর মুখটাই এমন ছিল, মেকআপ ছাড়াই ভয়ংকর। ও যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁ করে ওকেই দেখত। আমাদের জন্য ও ছিল পারফেক্ট।”
১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘পুরানা মন্দির’। সেই একই বছরে মুক্তি পাওয়া হিট ছবিগুলি হল ‘কসম পয়দা করনেওয়ালি’, ‘শারাবি’ বা ‘মশাল’। অমিতাভ, মিঠুন, অনিল কাপুরদেরর মতো বলি তারকাদের নিয়ে তৈরি এই সব ছবিগুলিকে জোর টক্কর দিয়ে অনেক কম বাজেটে তৈরি ওই ভৌতিক ছবিও (Bollywood horror movie) বক্স অফিসে সাড়া ফেলেছিল! সেই ছবিতেই আত্মপ্রকাশ অনিরুদ্ধর। আদপে যিনি চেয়েছিলেন হিরো হতে। বাবার অমতে পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়া হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ভাল চাকরি পেয়েও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল ছবিতে নামার অদম্য ইচ্ছে। আচমকাই সুযোগ পেয়ে যান। পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে ধরা পড়েছিল টিউমার। তারই চিকিৎসা করাতে তিনি এসেছিলেন মুম্বইয়ে (তৎকালীন বম্বে)। এদিকে র্যামসে ব্রাদার্স ততদিনে ‘পুরানা মন্দির’-এর কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। কিন্তু ছবির নির্মাতারা সেই সময় খুঁজে বেড়াচ্ছেন একটা ভয়ংকর মুখ। যাকে দিয়ে তোলা হবে ভূতূড়ে দৃশ্যগুলি। খবর পেয়ে অনিরুদ্ধ গিয়ে পৌঁছান সেখানে। তাঁকে দেখে কার্যত লাফিয়ে ওঠেন ছবির ইউনিট সদস্যরা। এমন ‘ভূতূড়ে মুখ’ পাওয়া যেন মেঘ না চাইতে জল।
[আরও পড়ুন: মঞ্চে ফিরছে ‘কোনি’র স্মৃতি, সৌমিত্র অভিনীত ক্ষিদদার ভূমিকায় দেবদূত, জানালেন অভিজ্ঞতা]
‘পুরানা মন্দির’ হিট হতেই চাকরি ছেড়ে দেন অনিরুদ্ধ। ছবিতে তিনি ছিলেন ‘সামরি’ নামের এক বিকটদর্শন দানবের ভূমিকায়। অন্ধকার হলে যাকে দেখে কার্যতই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হত দর্শকের। এমনকী ভিডিওর ছোট পর্দাতেও সেই আতঙ্কের রেশ থাকত একই মাত্রায়। এই সাফল্যকে মাথায় রেখেই ছবির নির্মাতারা তৈরি করেন ‘৩ডি সামরি’। সেই ছবি অবশ্য খুব একটা চলেনি। পরে ১৯৯০ সালে তৈরি হয় আরও এক ছবি ‘বন্ধ দরওয়াজা’। এটা অবশ্য হিট করেছিল। ততদিনে অবশ্য অনিরুদ্ধ ফের চাকরিতে ফিরে গিয়েছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কাজ করছেন।
কিন্তু নব্বই দশকের শুরুর সময়টা পেরিয়ে যাওয়ার পরে র্যামসে ব্রাদার্সের জনপ্রিয়তা ঝপ করে পড়ে যায়। ‘জি হরর শো’ অবশ্য সফল ছিল। টিভিতে সেই শো দেখতে বসে সেখানে অনিরুদ্ধর মুখের ক্লোজআপ অনেকেরই রাতের ঘুম কেড়ে নিত। এছাড়াও অন্য বহু ছবিতে মুখ দেখিয়েছেন নিপাট ভদ্রলোক, আপাদমস্তক সংসারী মানুষটি। স্ক্রিন শেয়ার করেছেন অমিতাভ, অনিল কাপুরদের সঙ্গে। কাজ করেছেন হলিউড ছবিতেও। কিন্তু আজও তাঁর পরিচয় ‘সামরি’ হিসেবেই। যুগ বদলেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে গিয়েছে। সেই যুগ মাত্র তিন দশক আগেরও হলেও পরিবর্তনের দ্রুততায় আজ কার্যতই মান্ধাতার আমল। সস্তা ভূতূড়ে ছবির জমানা আর নেই। তবু তার একটা অন্য ‘কাল্ট’ চরিত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই চরিত্রের প্রতীক অনিরুদ্ধ আগরওয়ালের মুখ।
অনিরুদ্ধর এখন বয়স ৭৩। অল্প বয়সে সিনেমায় নামার জন্য পাগলামির কথা ভাবলে হয়তো তাঁর এখন হাসিই পায়। আজ অবশ্য তিনি বোঝেন অভিনেতা হিসেবে খুব বড় তিনি ছিলেন না। কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে র্যামসে ব্রাদার্সের সঙ্গে যোগাযোগটা হয়ে যাওয়ার পর একটা সময় এমনও গিয়েছে, যখন তাঁকে কেন্দ্রে রেখেই ছবির কথা ভাবতেন হরর ছবির নির্মাতারা। যদিও সিনে বিশেষজ্ঞ জেরি পিন্টোর মতে, অনিরুদ্ধকে যে ভূমিকায় ব্যবহার করা হত সেখানে অভিনয় করতে পারাটা খুব জরুরি শর্ত ছিল না। হরর ছবিতে ভৌতিক দৃশ্যগুলিকে আতঙ্কঘন করে তুলতে দরকার ছিল ভয়াবহ এক মুখশ্রী। যা অনিরুদ্ধর ছিল। যা আজও আচমকা দেখলে চমকে ওঠেন মানুষ। শুধুমাত্র যে মুখের একটা ঝলক মুহূর্তে তুলে ধরে ফেলে আসা সময়ের ভৌতিক ছবির গোটা ধারাটাকেই।