সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: শিক্ষার আঁধার ঘুচিয়ে শবর জনজাতির মধ্যে আলো নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেই আলো যেন আরও উজ্জ্বল হল প্রান্তিক জনজাতি রমণিতা শবরের (Ramanita Sabar) সাফল্যে। এই প্রথম খেড়িয়া-শবর জনজাতির মধ্যে স্নাতকোত্তর হলেন রমণিতা। পুরুলিয়ার সিধো-কানহো- বিরসা বিশ্ববিদ্যালয় (Sidho-Kanho-Birsha University) থেকে স্নাতকোত্তরে ইতিহাস বিভাগে তিনি দ্বিতীয় হয়েছেন। তবে মেয়েদের মধ্যে প্রথম। আগামী মঙ্গলবার মার্কশিট দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। বৃহস্পতিবার পুরুলিয়ার অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর তাকে সংবর্ধনা দেয়।
তবে এই দীর্ঘ লড়াইটা কম কঠিন ছিল না। স্কুলের গণ্ডি টপকে স্নাতক হয়ে স্নাতকোত্তর হতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাঁকে। সকাল হলেই তির-ধনুক, লাঠি, বর্শা হাতে পাড়াপড়শি চলে যেত জঙ্গলে। তারপর গোসাপ, ব্যাঙ ‘শিকার’ করে নিয়ে এসে পুড়িয়ে, শাকপাতা সিদ্ধ করে চলত খাওয়া-দাওয়া। দুপুরের আগেই হাঁড়িয়ার নেশায় ডুবে যেত। তারপর সন্ধ্যা নামলেই পথে নেমে লুঠপাট। তাই ব্রিটিশরা এই জনজাতিকে ‘জন্ম অপরাধী’ আখ্যা দেয়। ফলে শৈশব থেকে শবরটোলায় এমন ছবিই দেখে এসেছিলেন রমণিতা শবর। সেইসব নিয়মের বেড়া ভেঙেই আজ জঙ্গলমহলে উজ্জ্বল মুখ রমণিতা।
[আরও পড়ুন: বাঁকুড়ার বেসরকারি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড, তিনতলা থেকে ঝাঁপ মহিলার]
পুরুলিয়ার (Purulia) জঙ্গলমহল বরাবাজার ব্লকের সিন্দরি গ্রাম পঞ্চায়েতের ফুলঝোর গ্রামে তাঁর মাটির বাড়ি। শিশু শিক্ষা থেকে প্রাথমিক পাঠ, এমনকী মাধ্যমিক পাস করেন ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার চৌকা থেকে। হিন্দি মাধ্যমে হস্টেলে থেকে লেখাপড়া চালানোর পর পুরুলিয়া শহরের কস্তুরবা হিন্দি বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক। তারপর পূর্ব সিংভূম জেলার পটমদা ডিগ্রি কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক। তবে এই দীর্ঘ পথে পদে পদে ছিল বাধা। শিশু শিক্ষা থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শবর জনজাতির কল্যাণ সাধনে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা রমণিতার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিলেও উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনায় প্রতিবন্ধক হয়ে গিয়েছিল অর্থ।
তিন ভাই-বোন আর বাবা-মার পাঁচজনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা তাঁদের। সামান্য চাষবাস, প্রাণীপালন, হাতের কাজ আর দিনমজুরির কাজ করে মাসে হাজার পাঁচেক টাকা হাতে আসে রমণিতার বাবা মহাদেব শবরের। সেই টাকা থেকেই ফি মাসে পুরুলিয়া শহরে শুধুমাত্র মেসের খরচ হিসাবেই দু’হাজার টাকা মেয়েকে দিতে হত। এমন বহু মাস গিয়েছে ছাগল, মুরগি বিক্রি করে বা ধারদেনা করে মেসের খরচ কোনওভাবে মেয়ের হাতে তুলে দিয়েছেন বাবা। কিন্তু একদিনের জন্যও বলেননি লেখাপড়া বন্ধ করে দে। কিন্তু পাড়া-পড়শি সবাই বলতেন, এত লেখাপড়া করে কী হবে? এমন কথায় কান ঝালাপালা হয়ে যেত শবর কন্যার। আজ যেন তারই জবাব দিচ্ছেন রমণিতা। তাঁর হস্তশিল্পও চোখ টানে।
[আরও পড়ুন: রীতি ভেঙে কালীপুজো নিয়ে লেকচার সিরিজের আয়োজন, ফের বিতর্কে বিশ্বভারতী]
রমণিতার কথায়, “অধ্যাপক হতে চাই। শবর জনজাতির মহিলাদের উচ্চশিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা আমার চ্যালেঞ্জ। তবে এখন বিএড করতে চাই। কিন্তু অর্থ নেই। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখব।” তবে এখন থেকেই নেট ও স্যাটেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতির অধিকর্তা প্রশান্ত রক্ষিত বলেন, “শবর জনজাতির নারীশিক্ষায় রমণিতা আজ উদাহরণ। নারী শিক্ষার আঁধার ঘুচিয়ে আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছেন ওই শবর তরুণী। শবরদের মধ্যে তিনিই প্রথম স্নাতকোত্তর। আমরা আজ গর্বিত।” গর্বিত সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক সুবলচন্দ্র দে বলেন, “শবর জনজাতির মধ্যে রমণিতা প্রথম স্নাতকোত্তর হল। এ আমাদের গর্ব।”