বিশ্বদীপ দে: যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধে, তবে তা হবে পরমাণু যুদ্ধ। এমনই ‘ধ্বংসাত্মক’ এক যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাশিয়া। এই মুহূর্তে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ (Russia-Ukraine Conflict) ঘিরে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে পরমাণু যুদ্ধের (Nuclear war) আশঙ্কা। এখনও তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্ত রুশ (Russia) ক্ষেপণাস্ত্র ইউরোপের বৃহত্তম পরমাণু কেন্দ্র জাপরজাইয়ে আছড়ে পড়ার পরে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক নতুন করে ঘনীভূত হতে শুরু করেছে। যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহৃত হয়? কোন অশনি সংকেত অপেক্ষা করে আছে পৃথিবীর জন্য?
আসলে ১৯৪৫ সালের নাগাসাকি ও হিরোশিমায় ‘ফ্যাট ম্যান’, ‘লিটল বয়’ নামের জোড়া বোমায় কেবল ওই দুই শহরই কেঁপে ওঠেনি। গত আট দশক ধরে পৃথিবীর মেরুদণ্ডে রয়ে গিয়েছে সেই কাঁপুনিরই অনুরণন। তাই যতবারই পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়, ততবারই শিউরে ওঠে সভ্যতা।
[ আরও পড়ুন: ‘কফিন আনতে বেশি জায়গা লাগে’, ইউক্রেনে মৃত পড়ুয়া ফেরানো নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য বিজেপি নেতার]
সভ্যতার গোড়া থেকেই যুদ্ধবিগ্রহ কম হয়নি। প্রতিটি ভয়াবহ যুদ্ধই একলপ্তে বদলে দেয় বহু জীবনের অভিমুখ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে সবচেয়ে উঁচু এক ‘মনস্টার’ হয়ে রয়ে গিয়েছে তার অন্যতম কারণ হিরোশিমা-নাগাসাকি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনলে আজও হাড় হিম হয়ে যায়। সভ্যতার কল্পনারও অতীত ছিল পারমাণবিক বিস্ফোরণের ভয়াবহতা। বিস্ফোরণের পাঁচ বছর পরে বেড়ে গিয়েছিল লিউকোমিয়া। দশ বছর পরে বাড়তে শুরু করে থাইরয়েড, স্তন ও ফুসফুসের ক্যানসার।
সেই বিস্ফোরণের কথা বলতে বসে একজনের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি সুতোমু ইয়ামাগুচি। ২৯ বছরের ইয়ামাগুচি ছিলেন নৌবাহিনীর এক ইঞ্জিনিয়ার। তিনি হিরোশিমা ও নাগাসাকি, দুই পারমাণবিক বিস্ফোরণের সময়ই সেখানে ছিলেন। এবং কী আশ্চর্য! তিনি বেঁচে যান। পরবর্তী সময়ে এই ভাগ্যবান মানুষটির বর্ণনাতেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল রাতারাতি ঝকঝকে দু’টি শহর নরকে পরিণত হয়েছিল।
[আরও পড়ুন: যন্ত্রণার মাঝেও সুর খুঁজে পেলেন বীরভূমের ‘বাদাম কাকু’, দুর্ঘটনা নিয়ে বাঁধলেন নতুন গান]
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল সোয়া আটটায় হিরোশিমায় ‘লিটল বয়’ আছড়ে পড়ার পরই প্রচণ্ড শব্দ ও আলোর ঝলকানিতে সংজ্ঞা হারান তিনি। যখন জ্ঞান ফেরে তখন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে চারপাশ। সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত এক অন্ধকার, যেমন অন্ধকার সচরাচর দেখা যায় না। মাথার উপরে ভেসে রয়েছে ছাইয়ে ঠাসা এক অতিকায় মৃত্যুমেঘ। বহু পরে ‘দ্য টাইমস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ”আমি সম্ভবত বেশ কিছুক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম। চোখ খুলতেই দেখলাম অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না। যেন কোনও ছবি শুরু হতে হতে চলেছে সিনেমা হলে। তখন যেমন দেখা যায়, তেমন ভাবেই শব্দবিহীন কালো একটা অবয়ব।”
কোনও মতে একটা শেল্টারে রাতটুকু কাটিয়ে তিনি যখন রেল স্টেশনে আসেন, সেই যাত্রাপথও ছিল ভয়ংকর। ভাঙা সেতু, বাড়ির ধ্বংসস্তূপগুলিতে তখনও জ্বলছে আগুনের শিখা। যত্রতত্র পড়ে আছে বীভৎস মৃতদেহ। নদী পেরোতে গিয়ে জ্বলন্ত মৃতদেহ সরিয়ে সরিয়ে সাঁতরাতে হচ্ছিল তাঁকে। এই মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে তিনি পৌঁছলেন নাগাসাকিতে। কে জানত সেখানে অপেক্ষা করে রয়েছে আরও ভয়াবহ ফাঁদ। তবে এবারও স্ত্রী ও পাঁচ মাসের সন্তান-সহ প্রাণে রক্ষা পেলেন তিনি। এমন অবিশ্বাস্য কপাল তাঁর। কিন্তু নরক দর্শনের সেই যন্ত্রণা তিনি সারা জীবনেও ভুলতে পারেননি। তাঁর শরীরেও প্রভাব পড়েছিল সাংঘাতিক। চুল উপড়ে বেরিয়ে এসেছিল। ক্ষতস্থানগুলিতে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। ঘনঘন বমি হচ্ছিল। তবুও তিনি বেঁচেই ফিরেছিলেন। ইতিহাসের পাতায় তাই তাঁর পরিচয় ‘ডবল হিবাকুশা’ হিসেবে। হিবাকুশা হলেন তাঁরা, যাঁরা পারমাণবিক বিস্ফোরণের সাক্ষী থেকেও পরিত্রাণ পেয়েছেন। সুতোমু ইয়ামাগুচির নামকরণে তাই ‘ডবল’ জুড়ে গিয়েছে।
হিরোশিমা ও নাগাসাকি আবার নতুন করে বেঁচে উঠেছে। কিন্তু তার শরীরে রয়ে গিয়েছে ইতিহাসের ক্ষত। গোটা শহর যেন মৃত্যুর এক হিম নিঃশ্বাসে স্থির হয়ে গিয়েছিল। আসলে হিরোশিমায় বিস্ফোরণের কেন্দ্রের সাড়ে চার কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকায় তাপমাত্রা পৌঁছে গিয়েছিল ৪ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বহু মানুষ স্রেফ গলে গিয়ে শূন্য়ে মিলিয়ে গিয়েছিলেন। নাগাসাকিতেও কমবেশি একই ছবি। ধ্বংসলীলার এমন থমথমে, করুণ প্রকাশ পৃথিবী তার আগে আর কখনও দেখেনি।
মনে পড়ছে ইশিরো হন্ডার কথা। হিরোশিমা-নাগাসাকি তাঁর মনের ভিতরে এমন ঘা সৃষ্টি করেছিল, যা থেকে কল্পনায় জন্ম নিয়েছিল এক অতিকায় প্রাণী। নাম ‘গজিরা’। সারা বিশ্ব যাকে চেনে গডজিলা নামে। সেই অতিকায় ও জীবনধ্বংসী মূর্তি আসলে মৃত্যু ও ধ্বংসের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’-এরই প্রতীকী ছবি। স্বামীর এই কীর্তি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী কিমি হন্ডা বলেছিলেন, ”উইদাউট দ্য বম্ব, দেয়ার কুড নট হ্যাভ বিন আ মনস্টার।” এই একটি সংলাপ বুঝিয়ে দেয়, বিস্ফোরণে কেবল তাৎক্ষণিক প্রাণহানি, ভোগান্তিতেই আটকে থাকে না। একটি জাতির মগজে পরমাণু বিস্ফোরণের ব্যাঙের ছাতা চিরকালীন এক ট্রমার জন্ম দিয়ে যায়। যা জীবনযাপন, সংস্কৃতির হৃদয়কেও এঁফোঁড় ওঁফোঁড় করে দেয়।
১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে প্রথমবার পরীক্ষামূলক ভাবে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। সেই সময় ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সর্বময় কর্তা বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার বিস্ফোরণ দেখতে দেখতে উচ্চারণ করেছিলেন গীতার শ্লোক। দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ যুপদুত্থিতা। অর্থাৎ একসঙ্গে হাজার সূর্যের ঝলকানি! কল্পনাও যেন হার মেনে যায়! প্রশ্ন ওঠে, ভয়াবহতার কথা জেনেও কেন পরমাণু বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল? এমনটা বলা হয়, পরীক্ষার সময় নাকি বোঝা যায়নি এতটাও বিপুল ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে। তর্কের খাতিরে সেকথা মেনে নেওয়া গেলেও, অনিশ্চিত অবস্থাতেও ওই হামলার পরিকল্পনা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের কাঠগড়ায় না তুলে উপায় নেই।
কিন্তু এমন ভয়ংকর দৃশ্যের জন্মও কি মানুষকে সচেতন করতে পেরেছে? পারলে নতুন সহস্রাব্দে পৌঁছেও পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় রদ টানা গেল না কেন? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ফের নতুন করে পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কাকে উসকে দিয়েছে। মনে পড়ছে ‘আগন্তুক’ ছবিতে উৎপল দত্তের সংলাপ। ”সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ, যে আঙুলের একটি চাপে একটি বোতাম টিপে একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসীসমেত একটি গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর সভ্য কারা জানেন? যারা এই অস্ত্র-প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে উইদাউট টার্নিং এ হেয়ার।” এই সংকট থেকে যে মুক্তি নেই সভ্যতার, তা যেন প্রতি মুহূর্তেই বুঝতে পারছি আমরা। একটি বোতাম ও একটি আঙুলের দূরত্বের ফাঁকেই আপাতত দিন গুজরান এই নীল গ্রহের। আশার আলোটুকুকে সম্বল করা ছাড়া আর উপায় কী?