কোয়েল মুখোপাধ্যায়: এ এক আশ্চর্য মরণফাঁদ! বিপর্যয় এখানে ভবিতব্য। প্রকৃতির লিখন বলা যায়। বারে বারে শুধু ভোল পালটায়। কখনও আসে ভূমিকম্প রূপে। কখনও ভূমিধস বা তুষার ধস। আবার কখনও হড়পা বান হয়ে। পাঁচ দেশের সীমানা জুড়ে বিস্তৃত, বিশ্বের সব থেকে উঁচু পর্বতমালা, হিমালয় যেন আক্ষরিক অর্থেই ‘ভয়ংকর সুন্দর’। বর্তমানে নির্মীয়মাণ টানেলে ধসের কারণে ৪১ জন শ্রমিকের আটকে থাকার খবর ঘিরে শিরোনামে থাকা উত্তরাখণ্ড (Uttarakhand) রাজ্যটি এই গাঙ্গেয় হিমালয়েরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এটাই সাম্প্রতিক অঘটনের মূল কারণ।
গত ১২ নভেম্বর উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার যমুনোত্রী জাতীয় সড়কে একটি নির্মীয়মাণ টানেল ভেঙে পড়ে। ভিতরে আটকে পড়েন ৪১ জন শ্রমিক। দ্রুতগতিতে শুরু হয় উদ্ধারকাজ। দেশীয় বিশেষজ্ঞ এবং প্রযুক্তির পাশাপাশি সাহায্য নেওয়া হয় বিদেশি বিশেষজ্ঞেরও। উদ্ধারকাজের প্রক্রিয়া এখনও চলছে। কিন্তু গত দশ-এগারো দিনে বার বার যে প্রশ্নটা সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে তা হল–এই বিপর্যয় সেখানে কেন ঘটল? কেন বার বার উত্তরাখণ্ডেই একের পর এক বিপর্যয় নেমে আসে? এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। ভৌগোলিক ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করা যাক।
হিমালয়ের কোলে রয়েছে পাহাড়ি এই রাজ্য। সেই হিমালয়, যা পৃথিবীর নবীনতম পর্বতমালা। উত্থান-পর্ব এখনও চলছে। ভৌগোলিকদের দাবি, পশ্চিম থেকে পূর্বে বিস্তৃত এই গোটা অঞ্চলটাই অত্যন্ত কম্পনপ্রবণ, অস্থির-অস্থিতিশীল এবং অতিমাত্রায় সক্রিয়। ভূ-তাত্ত্বিকদের ভাষায় ‘টেকটনিক্যালি অ্যাক্টিভ’। এর চারটি প্রধান অংশ আছে। ট্রান্স হিমাদ্রি থ্রাস্ট, মেন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট (এমসিটি), মেন বাউন্ডারি থ্রাস্ট (এমবিটি) এবং মেন ফ্রন্টাল থ্রাস্ট। এছাড়াও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র ছোট-বড় চ্যুতি বা ‘ফল্ট’। উত্তর ভারতের অধিকাংশ শহর যেমন যোশীমঠ, আলমোড়া, নৈনিতাল, মুসৌরি, হৃষীকেশ, দেরাদুন, উত্তরকাশী, টেহরি, শ্রীনগর, বাগেশ্বর, মুনসিয়ারি, গোপেশ্বর, গঙ্গোত্রী, বদ্রীনাথ, কেদারনাথ পড়ে এই ‘এমসিটি’ অথবা ‘এমবিটি’র মধ্যে। এর মধ্যে রয়েছে সেই উত্তরকাশী, যেখানে সুড়ঙ্গ-বিপর্যয় ঘটেছে। শুধু তাই নয়।
[আরও পড়ুন: পাঞ্জাবের গুরুদ্বারে গুলিবৃষ্টি, ‘নিহঙ্গ’ শিখদের তাণ্ডবে নিহত পুলিশকর্মী]
পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে উত্তরাখণ্ডে বিপুল হারে বেড়েছে শহুরে অধিবাসীর সংখ্যা। ‘আর্বান পপুলেশন’। নগরায়ণের জন্য যথেচ্ছভাবে কাটা হয়েছে গাছ, কাটা হয়েছে মাটি। যে এলাকা ‘পরিবেশগত’ ভাবে দুর্বল, যেখানে মাটি নরম, রেয়াত করা হয়নি তাকেও। এই ‘চাপ’-এরই খেসারত দিতে হচ্ছে সভ্য সমাজকে। পর পর ধেয়ে আসছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। একই দাবি হায়দরাবাদের সিএসআইআর-ন্যাশনাল জিও-ফিজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. পূর্ণচন্দ্র রাও-এরও। তাঁর কথায়, ‘‘উত্তরাখণ্ড এমন একটি ‘সিজমিক গ্যাপ’-এ অবস্থিত, যেখানে যখন তখন ভূমিকম্প ঘটতে পারে।’’
দ্বিতীয় স্থানীয়দের বিশ্বাস। উত্তরকাশীর যে সুড়ঙ্গে ধস নেমেছে, তার প্রবেশের মুখেই না কি ছিল একটি ছোট মন্দির। গ্রামবাসীরা বলতেন, ‘ভৌকনাগ দেব কি মন্দির’। সুড়ঙ্গ নির্মাণ শুরু হওয়ার প্রথম দিকে, না কি সেখানে পুজো দিয়ে কাজে যেতেন কর্মী-আধিকারিকরা। কিন্তু মাঝপথে নতুন ম্যানেজমেন্ট এসে সেই মন্দির ভেঙে দেয়। স্থানীয় বাসিন্দা, ধনবীর চাঁদ রমোলার আক্ষেপ, ‘‘দেবতা রুষ্ট হয়েছেন। তাই এই অঘটন।’’
তৃতীয়, নির্মাণকারী সংস্থার (লার্সেন অ্যান্ড টুবরো) প্রাক্তন প্রোজেক্ট পরিচালকের ব্যাখ্যা। মনোজ গারনায়েক জানিয়েছেন, সুড়ঙ্গের যে অংশটি ভেঙে পড়েছে, টানেলের মুখ থেকে তার দূরত্ব ২০০-৩০০ মিটার। ওই জায়গার শিলার একটি স্তর আগাগোড়াই ভঙ্গুর ছিল। পাশাপাশি জলের ক্ষরণে তা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। ড্রিলিং শুরু হতেই তা ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়েছে।
[আরও পড়ুন: সুড়ঙ্গ বিপর্যয়: লোহার জালে ড্রিল আটকালেও চূড়ান্ত পর্যায়ে উদ্ধার অভিযান, শ্রমিকদের মুক্তির অপেক্ষায় দেশ]
চতুর্থ কারণ, আগাম সতর্কতা উপেক্ষা করা। যে চার ধাম প্রকল্পের অংশ হিসাবে সিল্কায়রা এবং দণ্ডলগঁাও-এর মধ্যে এই ৪.৫ কিলোমিটারের সুড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছিল, সেই জায়গা যে এই নির্মাণের উপযুক্ত নয়, তা জানিয়ে বহু আগে থেকে সরব হয়েছিলেন ভূ-তাত্ত্বিক এবং পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, ওই এলাকায় ভারী খনন এবং নির্মাণ চালালে পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি ধসও হতে পারে। বিশেষ করে উত্তরাখণ্ডে সাম্প্রতিক অতীতে যে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে, সে বৃত্তান্তও তুলে ধরেছিলেন পরিবেশবিদরা। এই নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে থেকে আইনি আকচা-আকচিও চলেছে। কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থও হতে হয়েছে পক্ষ-বিপক্ষের সকলকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনও লাভই হয়নি। নির্মাণকাজ চলেছে সব বাধা গুঁড়িয়ে দিয়ে। ফলও হয়েছে ততটাই মর্মান্তিক। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ চলতে গিয়ে প্রাণ যেতে বসেছে উলুখাগড়া-রূপী হতভাগ্য শ্রমিককুলের।