গৌতম ব্রহ্ম: ঘরে পা রাখার যোগ্যতা আছে। অথচ ঢোকার উপায় নেই! দোর যে রুদ্ধ! আয়ুর্বেদিক (Ayurveda) শল্য চিকিৎসকদের সামনে এ যাবৎ বন্ধ হয়ে থাকা সেই দরজার কপাট ধীরে ধীরে খুলছে। অ্যালোপ্যাথ সার্জনদের মতো বিভিন্ন অস্ত্রোপচারের সুযোগ এবার তাঁরা পাবেন। আয়ুশ বিস্তারে যা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শল্য চিকিৎসার জনক বলে মনে করা হয় সুশ্রুতমুনিকে। তা সত্ত্বেও আইনি গেরোয় শল্য চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা ‘জেনারেল সার্জারি’-র সুযোগ বা অধিকার, কোনওটাই পাচ্ছিলেন না।
অর্শ, ভগন্দর, ফিসচুলা বা হাইড্রোসিলের মতো গুটিকয় মামু্লি অস্ত্রোপচারে আটকে আবদ্ধ ছিল তাঁদের কাজ। এবার শাপমুক্তি। কেন্দ্রীয় সরকার আইন সংশোধন করে আয়ুর্বেদ সার্জনদের কাজের পরিধি বাড়িয়ে দিল। ফলে এখন জেনারেল সার্জারির আওতাভুক্ত প্রায় সব অস্ত্রোপচারের টেবিলে ওঁরা ছুরি-ফরসেপ ধরতে পারবেন। তা সে অ্যাপেনডিক্স বাদ দেওয়া হোক বা দাঁত তোলা, কিংবা টনসিল বা নাকের প্লাস্টিক সার্জারি। এমনকী, কোলেস্টোমি ও হার্নিয়া অপারেশনও করতে পারবেন আয়ুর্বেদে এমএস সার্জনরা।
৩ জানুয়ারি এই সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ। সেখানে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল যে, আয়ুর্বেদ সার্জনদের কাজের পরিধি বাড়তে চলেছে। অবশেষে তাতে সরকারি সিলমোহর পড়ল। শ্যামবাজার জে বি রায় আয়ুর্বেদ কলেজ হাসপাতালে অবশ্য নিয়মিত অস্ত্রোপচার (Operation) হয়। দু’জন শল্য চিকিৎসক সপ্তাহে গড়ে প্রায় দশটি অপারেশন করেন। তবে সবই অর্শ, ভগন্দর, ফিসচুলার মতো ‘অ্যানোরেকটাল সার্জারি’। জে বি রায়ের সার্জারির অধ্যাপক ডা. অর্ণব রায়ের কথায়, “সুযোগ পেলে এখানে সপ্তাহে তিরিশটি অপারেশনও করা সম্ভব। আয়ুর্বেদ হাসপাতালে অ্যানাস্থেশিস্টও রয়েছেন। এখন কিছু উন্নত যন্ত্রপাতি চাই। আর চাই বিমার সুবিধা। যাতে আয়ুর্বেদ নিয়ে পড়াশোনা করা শল্য চিকিৎসকরা আয়ুর্বেদ হাসপাতালের বাইরেও অস্ত্রোপচার করতে পারেন।”
[আরও পড়ুন: ৩০ সেকেন্ডেই খতম ৯৯.৯% করোনা! নতুন মাউথওয়াশ নিয়ে দাবি ইউনিলিভারের]
ঘটনা হল, বছর দশেক আগেও জেবি রায় কলেজের প্রসূতি বিভাগের লেবার রুমে সিজার হত। লাল আলো জ্বলত ওটিতে। কিন্তু সরকারি বিধিনিষেধ ও আইনি জটিলতার জেরে সেই সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। এখন আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের স্যালাইন দেওয়ারও অনুমতি নেই। অথচ যে কোনও অস্ত্রোপচারের আগে-পরে রোগীকে ‘আইভি ফ্লুইড’ দিতেই হয়। দিতে হয় টিটেনাস-সহ বেশ কিছু ইঞ্জেকশন, ঘা শুকানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক। এগুলো প্রয়োগের স্বাধীনতা না পেলে একুশ শতকে সার্জারি করা মুশকিল। এমনটাই মনে করছেন অর্ণববাবু। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “সার্জারি নিয়ে কেন্দ্রের সংশোধনীকে স্বাগত জানাচ্ছি। এর ফলে আয়ুর্বেদে সার্জারি নিয়ে পড়াশোনা করা পড়ুয়ারা হাতে-কলমে অপারেশন শিখতে পারবে, অনুশীলন করতে পারবে। কিন্তু কিছু পরিবর্তন চাই। নচেৎ কোনও লাভ নেই।”
আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের দাবি, এখন তাঁরা অনেক জটিল অপারেশন করার দক্ষতা রাখেন। রাইনোপ্লাস্টি-র মতো জটিল অস্ত্রোপচারের উল্লেখ রয়েছে সুশ্রুত সংহিতায়। টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধে জখম ব্রিটিশ সৈনিকের কাটা নাক জোড়া লাগিয়েছিলেন এক মাদ্রাজি বৈদ্য। প্রায় ২৬০০ বছর আগে মহর্ষি সুশ্রুত মাছের পটকায় জল ভরে ছাত্রদের অস্ত্রোপচার শিখিয়েছিলেন। সুশ্রুত সংহিতায় ১০১ রকম সার্জারি যন্ত্র ও ২০ রকম শস্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং প্রাচীন শল্যশাস্ত্রকে আধুনিকযুগে যথাযথ ভাবে প্রয়োগ কেন করা হবে না, সে প্রশ্ন দানা বাঁধছে অনেক দিন ধরে।
এমতাবস্থায় আশা জাগাল সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ান মেডিসিন (সিসিআইএম))-এর পরমার্শ মেনে তৈরি কেন্দ্রীয় আইন। রাজ্য আয়ুর্বেদ পরিষদের সহ-সভাপতি ডা. প্রদ্যোৎবিকাশ কর মহাপাত্র জানিয়েছেন, “এদেশে সার্জেনের আকাল। প্রান্তিক মানুষের সেবায় যদি প্রশিক্ষিত আয়ুর্বেদ সার্জনদের কাজে লাগানো যায়, তাতে তো সমাজেরই লাভ।” মডার্ন মেডিসিনের চিকিৎসকদের একাংশ অবশ্য এই সরকারি গেজেটের তীব্র বিরোধিতা করেছেন।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)-র বঙ্গীয় শাখার সম্পাদক ডা. শান্তনু সেন ও ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম’-এর সম্পাদক ডা. কৌশিক চাকি জানিয়েছেন, “এই আইন শুধু চিকিৎসক বিরোধী নয়, জনবিরোধীও। বর্তমান সরকার কোয়াক তৈরির কারখানা বানাতে চাইছে। অবিলম্বে এই আইন প্রত্যাহার করতে হবে।” ‘ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর বঙ্গীয় শাখার তরফে ডা. রাজু বিশ্বাস জানিয়েছেন, “এই ক্রসপ্যাথি মেনে নেওয়া অসম্ভব। এতে হাতুড়েরা উৎসাহিত হবেন। দাঁত তোলা বা রুট ক্যানেল করার অনুমতি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
নয়া আইনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ‘অল ইন্ডিয়া সার্জিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর বঙ্গীয় শাখার ভাবি প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মাখনলাল সাহা। তিনি জানিয়েছেন, “এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা। হাতেগোনা কয়েকটি অ্যালোপ্যাথি ওষুধ প্রেসক্রাইব করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে আয়ুশ (Ayush) চিকিৎসকদের। তাই নিয়ে জেনারেল সার্জারি অসম্ভব। পাঠ্যক্রমে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।” যদিও অ্যালোপ্যাথদের একাংশ কেন্দ্রের এই আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মত, মডার্ন মেডিসিনে এমএস করা সার্জনরা গ্রামে যেতে চান না। রাতবিরেতে ব্যথা উঠলে কোয়াকরাই অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন করেন। সেখানে তিন বছর এমএস করার পর আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা যদি অস্ত্রোপচার করেন ক্ষতি কী?