কিশোর ঘোষ ও রমেন দাস: বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান দু'টি ধারা হল মুজিবুর রহমান-শেখ হাসিনা (আওয়ামি লিগ) এবং জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়া (বিএনপি)। জুলাই-আগস্ট গণবিক্ষোভে দেশছাড়া হাসিনা (Sheikh Hasina), অন্যদিকে প্রয়াত খালেদা জিয়া (Khaleda Zia)। এই অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি এক বিপজ্জনক শূন্যতা তৈরি হল? এই শূন্যতার ফায়দা তুলবে তৃতীয়পক্ষ মৌলবাদী জামাত শিবির? বাংলাদেশের ভবিষ্যত কী? বিষয়টি নিয়ে মুখ খুললেন আওয়ামি (বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও) ও বিএনপি নেতা, পদ্মাপাড়ের প্রগতিশীল লেখক, চিন্তক ও সাংবাদিক। ঠিক কী বলছেন তাঁরা?
এই বিষয়ে আওয়ামি নেতা এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল খান বলেন, "এক সময় 'মাইনাস টু' ষড়যন্ত্র করে মৌলবাদী পক্ষ, অর্থাৎ কিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সরানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশের মানুষের চাপে তা সম্ভব হয়নি। ওই ষড়যন্ত্রে মহম্মদ ইউনুসের একটা ভূমিকা ছিল। কাকতালীয় ভাবে আজকে সেই ইউনুসই নেতৃত্বে।" বাংলাদেশের (Bangladesh) প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করিয়ে দেন, মুক্তিযুদ্ধে "জামাত ইসলাম পাকিস্তানিদের সাহায্য করতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী তৈরি করে, ভবিষ্যতে যাঁরা নেতা হতে পারতেন তাঁদের হত্যা করে। তথাপি এতদিন তারা ক্ষমতায় আসতে পারেনি। এখন ইউনুসের আমলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।" প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করেন, হাসিনা-খালেদার অনুপস্থিতিতে জামাতই দেশে নিয়ন্ত্রক। তিনি বলেন, "রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিএনপিকে দেখা গেলেও জামাতের প্রতিনিধিত্বে পাকিস্তানই এখন দেশ চালাচ্ছে। হতে পারে নির্বাচনের নামে তামাশা করে এবার তারা সরকারেরও চলে আসল।"
সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য প্রাক্তন সাংসদ এবং বিএনপি নেতা শামসুজ্জামান দুদুর। জামাতই যে ক্ষমতায় আসছে, নির্বাচনের আগে তা মানতে রাজি নন তিনি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধর্মীয় মৌলবাদের বিষয়টিও তিনি উড়িয়ে দেন। বিএনপি নেতা বলেন, "জামাত ক্ষমতায় আসছে এখনই বলা যাবে না। তাছাড়া উপমহাদেশে ধর্ম আশ্রিত রাজনীতি খুব একটা সমর্থন পায়নি। অতএব, বাংলাদেশের ভবিষ্যত অত্যন্ত উজ্জ্বল। এখনকার মানুষ গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতাকামী। অতএব, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের (Bangladesh) রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বলা যাবে না।"
আওয়ামি এবং বিএনপি নেতা উভয়ের বক্তব্য খণ্ডন করছেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল চিন্তক এবং লেখক বাকী বিল্লাহ। তাঁর বক্তব্য হল হাসিনা এবং খালেদা দু'জনেই বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী। বাকী বিল্লাহ বলেন, "হাসিনা-খালেদা অনন্তকাল এমনিতেই থাকতেন না। ফলে শূন্যতার যে প্রশ্ন তা অনিবার্যই ছিল। তৃতীয় পক্ষের ইঙ্গিতে সাধারণত উগ্র ডানপন্থার ভয়টাই মুখ্য, ইসলামী উগ্রপন্থার ভয়। হাসিনা এবং খালেদা উভয়েই সেটার পালে হাওয়া দেওয়া বা তাকে বিকশিত করতে ভূমিকা রেখেছেন। একে অপরের সঙ্গে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উভয়েই উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করেছেন। হাসিনার দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা ধর্মবাদী গোষ্ঠীর জন্য দারুণ অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।" ইতিমধ্যে অবশ্য অসুস্থ মায়ের টানে দেশে ফিরেছেন খালেদাপুত্র তারেক রহমান। তিনি ফেব্রুয়ারির ভোটে একাধিক আসনে লড়ছেনও।
আজকের ভারতবিদ্বেষ, মৌলবাদীদের বাড়বাড়ন্তের জন্য দুটো দলকেই দায়ী করে প্রগতিশীল লেখকের বক্তব্য, "তারা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে পারলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। এমনিতে ইসলামিস্টরা ভোটের রাজনীতিতে খুব সুবিধাজনক পর্যায়ে কখনই ছিল না, এখনও চলে এসেছে এমনটা নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে যে আওয়ামির দুঃশাসন-লুটপাটে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির ইমেজ জনগণের কাছে একদমই সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। নতুন কোনও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিও গড়ে ওঠেনি, যাদের উপর মানুষ ভরসা করতে পারে।"
জামাত এখনই ক্ষমতায় আসতে না পারলেও তারাই যে নতুন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক, এই বিষয়ে একমত মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক ও সম্পাদক চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ। তিনি বলেন, "বাংলাদেশের রাজনীতি এক অস্থিরতার মধ্যে আছে। আওয়ামি লিগ ও বিএনপি দল দু'টি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও তারা মধ্যপন্থী দল। এই দল দু'টি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দু'টি দল। এই দু'টি দলের নেতৃত্বে শূন্যতার পুরো সুযোগ নেবে মৌলবাদী জামাত-ই-ইসলামী। এখন তাদের উত্থান ঘটছে। এরা ক্ষমতায় যেতে না পারলেও ক্ষমতার বলয়ের কাছাকাছি আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।"
বিশ্লেষকদের বক্তব্য, গণবিক্ষোভে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটে নাগাদ দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। কার্যত এরপর থেকেই মৌলবাদীদের দখলে চলে গিয়েছে বাংলাদেশ। জামাতের 'কথা বলা পুতুল' হিসাবে কাজ করছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস। সেই কারণেই সে দেশে ভারতবিদ্বেষের সমান্তরালভাবে বাড়ছে পাকিস্তান প্রীতি। সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ মাত্রাছাড়া পর্যায় পৌঁছয়। খুন, বাড়ি-সম্পত্তি ধ্বংসের পাশাপাশি গায়ের জোরে ছেটে ফেলা হয় বহু হিন্দু প্রশাসনিক আধিকারিকদের। অবসর নিতে বাধ্য করা হয় সংখ্যালঘু অধ্যাপক ও শিক্ষকদের। ভেঙে ফেলা হয় পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের পূর্বপুরুষের বাড়ি, আক্রমণের মুখে বাউল, রবীন্দ্রনাথ, এমনকী জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা'। সবচেয়ে বড় কথা নিজেদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে (মুক্তিযুদ্ধ) মানে না আজকের বাংলাদেশের নেতারা। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় 'ভিলেন' বানায় তারা। সত্যি এতটা খারাপ পরিস্থিতি? পরে এই ছাত্রদের দল এনসিপি জোট গড়লেও ইতিমধ্যে তা ভেঙে জামাতের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
উত্তর মিলেছে তারেক হোসেন শুভ্র (নাম পরিবর্তিত) নামের পদ্মাপাড়ের এক সাংবাদিকের বক্তব্যে। বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের সিনিয়র সাংবাদিক এবং প্রখ্যাত লেখক তিনি। সেই তাঁকে বিএনপি-জামাত সমর্থক সম্পাদক মশাই সম্প্রতি 'ওএসডি' (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করে রেখেছেন। নামেই 'ওএসডি', আসলে তিনি নিয়মিত অফিসে আসলেও কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকী গত তিন মাস হল তাঁর বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোন অপরাধে? শুভ্র তাঁর পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক বন্ধু এই প্রতিবেদককে বলেন, "আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, প্রগতিশীল মানসিকতার, উচিত কথা বলি। এটাই আমার অপরাধ।"
কঠিন পরিস্থিতিতেও শুভ্র তাঁর নিজের বক্তব্য থেকে সরেননি। বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মন্তব্য, হাসিনা-খালেদার অনুপস্থিতি "কোনও শূন্যতা নয়৷ আওয়ামি লিগ পলাতক, আর বিএনপি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। মৌলবাদীরা সব নিয়ন্ত্রণ করছে। ইসলামিস্টরা সরকার গঠন করতে চলেছে। আজকে যে শূন্যতার কথা বলা হচ্ছে তা শুরু হয়েছে এক দশক আগে। হয়তো বা তারও আগে থেকে। যখন তারেক রহমানের কথিত ছত্রছায়ায় শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলায় মেরে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তারপর থেকে দুই নেত্রী আর পরস্পরের মুখোমুখি হননি। তারপর থেকেই বাংলাদেশ মৌলবাদের উত্থান।" এর থেকে কি মুক্তির পথ নেই? উত্তর দেবে সময়।
