সুকুমার সরকার, ঢাকা: মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে বাংলা তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটকের। 'অযান্ত্রিক'-এর স্রষ্টাকে নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আয়োজন। পত্র-পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা। অথচ সেই মহান স্রষ্টার বাংলাদেশের রাজশাহীর পৈতৃক বাড়ি আজও ধ্বংসস্তূপ! গত বছর ভগ্নপ্রায় বাড়িটিতে ভাঙচুর চালায় একদল দুষ্কৃতী। এমনিতেই দেয়ালে বয়সের গভীর দাগ, ঘরজুড়ে আগাছার রাজত্ব। সময়ের ধুলোয় মিশে থাকা স্মৃতির গন্ধ—সব মিলিয়ে যেন এক নিঃসঙ্গ শোকগাথা। যাকে নিয়ে গর্বিত হওয়ার কথা বাঙালির, তাঁর শৈশব-যৌবনের আশ্রয়স্থল আজ অবহেলার অন্ধকারে নিমজ্জিত।
ঋত্বিকের পৈতৃক বাড়িটি রয়েছে রাজশাহীর মিয়াপাড়ার ঘোড়ামারা এলাকায়। বাড়ি কি আর বলা যায়? খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাল ইটের স্তূপ, শ্যাওলায় মোড়া ভাঙা পাঁচিল, প্রাচীন ইমারতটির ভগ্নদেহের টুকরো টুকরো অংশ। ফাটা দেয়ালের গায়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কিছু দেয়ালচিত্র, যার একটি ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকীর স্মারক। উল্লেখ্য, ভগ্নদশায় থাকা এই বাড়িটিকে গত বছরই ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এখন শুধু আছে কিছু ইটের স্তূপ আর অতীতের স্মৃতির ভগ্নাংশ।
১৯২৫ সালে জন্ম ঋত্বিক ঘটকের। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছিলেন এই রাজশাহীতেই। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তাঁর পরিবার ভারতে পাড়ি দিলে বাড়িটিকে জেলা প্রশাসন "অর্পিত সম্পত্তি" হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। ১৯৮৫ সালে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইজারাকৃত ওই জমিটি কিনে নেয়। তবে ভবনটি তারপরও অক্ষত অবস্থায় টিকে ছিল বহু বছর। কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আনিসুর রহমান বলেন, 'আমরা কখনই চাইনি ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটা ভেঙে ফেলা হোক। আমরা এটাকে হাসপাতালের বহির্বিভাগ হিসেবে ব্যবহার করতাম। একদল সাবেক শিক্ষার্থী ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছিল। আমরা তাঁদের নিষেধ করেছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এক সন্ধ্যায় তারা আমাদের না জানিয়ে ভেঙে ফেলে। তবু, প্রতি বছরের মতো এবারও ঋত্বিক ঘটকের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সেখানে অনুষ্ঠান হবে।'
ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবির লিটন বলেন, 'ঋত্বিক ঘটক তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন রাজশাহীতে। এখানকার পরিবেশ ও সংস্কৃতি তাঁর চলচ্চিত্র ভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পদ্মা নদী, বরেন্দ্র জাদুঘর, এমনকী পাশের পাবলিক লাইব্রেরি... সবকিছুই তাঁর সংবেদনশীলতাকে গড়ে তুলেছিল। ২০০৮ সালে আমরা যখন এই ফিল্ম সোসাইটি গঠন করি, তখন অনেকেই জানতেন না যে ঋত্বিক ঘটক রাজশাহীতে থেকেছেন। আমরা তাঁর পৈতৃক বাড়ি থেকেই অনুষ্ঠান ও উৎসব শুরু করি এবং ২০০৯ সালে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখি "ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি"।
লিটন স্মৃতিচারণ করেন, 'ওই বাড়িটিতে একসময় ছিল বৈঠকখানা, শোবার ঘর, উঠান ও একটি পুরনো কূপ। এরশাদ সরকারের আমলে ওই ফাঁকা জমিতেই হোমিওপ্যাথিক কলেজ স্থাপন করা হয়। আমরা বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি তুলেছিলাম, এমনকী প্রশাসনের কাছ থেকে সংস্কারের আনুমানিক ব্যয় ৫২ লাখ টাকার হিসাবও পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর বাস্তবায়িত হয়নি।'
ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদ প্রতি বছর ৪ নভেম্বর ঋত্বিকের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে। লিটন বলেন, 'তবে এবার আর বাড়িটি নেই। আমরা আশা রাখি, একদিন এই স্থানটিকে তার স্মৃতিরক্ষায় একটি জাদুঘর বা চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউটে পরিণত করা হবে।' সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন বলেন, 'আমরা অনেকদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি যেন ঋত্বিক ঘটকের নামে এখানে কিছু প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় আমরা নথিপত্রে পাই যে জমিটির মূল মালিক ছিলেন ঋত্বিক ঘটকের মা ইন্দুবালা দেবী। কলেজ কর্তৃপক্ষ সরাসরি মালিকানা দাবি করতে পারে না—এরশাদ সরকারের সময় জমিটি শুধু ইজারা দেওয়া হয়েছিল।'
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটির মডারেটর অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন বকুল বলেন, 'ভবনটি ভেঙে ফেলার পর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তারা ইজারার জমিটি নিজেদের নামে নথিভুক্ত করে কলেজের সম্পত্তি হিসেবে দাবি করছে।' এ বিষয়ে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) টুকটুক তালুকদার বলেন, 'যখন ভবনটি ভাঙা হয়, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। মালিকানা ও ভাঙার প্রসঙ্গটি অধ্যক্ষই ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।'
এতকিছুর পরও যারা ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি বুকে ধারণ করেন, তারা এখনও তার নাম ও কাজকে জীবিত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের কাছে রাজশাহীর সেই ধ্বংসাবশেষ শুধু ভাঙা ইট-পাথর নয়। এটি এক চলচ্চিত্রপ্রতিভার জন্মভূমির শেষ নিদর্শন—যিনি একদিন বাংলা তথা বিশ্ব সিনেমার ধারা বদলে দিয়েছিলেন।
