সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: মনের যত কথা এখন উগড়ে দেওয়া হয় সোশাল মিডিয়ার পাতায়। আনন্দ, দুঃখ, হইহুল্লোড়, নিঃসঙ্গতা - ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের দেওয়ালে সবকিছুর সপাট প্রতিফলন! ঘরের কোণে বইয়ের তাকে এখন ধুলো জমছে রোজনামচা লেখা ডায়েরি, নোটবুকে। তাকে আর নেড়েঘেঁটে কেউ দেখেও না, তার পাতা ভরিয়ে কেউ কিছু আর লেখেও না। যুগান্তর এমনই এক পরিবর্তনের নাম। কিন্তু না, হারানো সম্পদ তো ফিরিয়ে আনা যায় ইচ্ছে থাকলে। আর সেটাই হল পুরুলিয়ার আড়শায় বিডিও অফিসে।
রোজকার পুরনোর সেসব ডায়েরি ব্লক কার্যালয়ে ফিরিয়ে আনলেন আড়শার বিডিও গোপাল সরকার। যার আক্ষরিক নাম 'মনের পাতা'! সেই মনের খাতার পাতায়-পাতায় ব্লকে পরিষেবা নিতে এসে মানুষজন তাঁদের নিজস্ব অনুভূতি, কাজ নিয়ে অভাব- অভিযোগ, সমস্যা জানাতে পারবেন। সেসব পাতা উলটে সমস্যার কথা জেনে সমাধান করবে ব্লক প্রশাসন। সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে জনসংযোগ আরও নিবিড় করে পরিষেবার উন্নতি করতে সম্প্রতি এই 'মনের পাতা' চালু করেছে আড়শা ব্লক প্রশাসন। যা রাখা হয়েছে বিডিওর টেবিলে। মানুষের মন পড়তেই এমন সাধু উদ্যোগ। ইতিমধ্যেই সেই 'মনের পাতা'-র কথা শুনে এক অসহায় বৃদ্ধার বাড়ি ঘুরে এসেছেন বিডিও।
এক সময় ডায়েরি, নোটবুকই ছিল মনের অনুভূতি লিখে রাখার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। কিন্তু এই ইন্টারনেটের যুগে বদল এসেছে। এই চলমান যুগে জীবনের ছোট ছোট কথা, অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হচ্ছে ফেসবুক, ইনস্টাতে। ফলত কমে আসছে লেখার অভ্যাস। আড়শার বিডিও-র উদ্যোগে এই 'মনের পাতা' জঙ্গলমহলের এই ব্লকে যেন লেখার অভ্যাসও ফিরে আসছে। বিডিও-র কথায়, "ব্লকে এসে মানুষজন সঠিক পরিষেবা পাচ্ছেন কিনা, কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা, আধিকারিকরা ভালো ব্যবহার করছেন তো? একটা কাজের পরিষেবা পেতে কত সময় লাগল? এসব লিখবেন গ্রাহকরা। এছাড়া কোনও ভালো কাজের জন্য তাঁদের মতামতও নেওয়া হচ্ছে। পরিষেবা পেয়ে তাঁর মনের অনুভূতি কী, সেই কথাগুলো যাতে মানুষ লিখে যেতে পারেন সেই কারণেই আমরা এই 'মনের পাতা' চালু করেছি। সব সময় আধিকারিক-আমলাদের কাছে সাধারণ মানুষজন নিজেদের মনের কথা বলতে পারেন না। মতামতের নিরিখে কোথাও যেন ফাঁক না থেকে যায়, যার ফলে উন্নয়নের কাজে বাধা না পড়ে, তাই এই উদ্যোগ। সবমিলিয়ে জনসংযোগের ভিতকে আরও মজবুত করতেই আমাদের এই প্রয়াস।"
সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে জনতার সংযোগের বাধা কাটিয়ে উন্নয়নে আরও জোর দিতে এই উদ্যোগ বিডিওর। ছবি: প্রতিবেদক।
একেবারে অযোধ্যা পাহাড়ের নিচেই সবুজে ঘেরা এই ব্লক। প্রায় ১ বছর ২ মাস হল বিডিও গোপাল সরকার এখানকার উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। অতীতে এই ব্লক ছিল মাওবাদী উপদ্রুত। ফলে জঙ্গলঘেরা এই ব্লকে উন্নয়নের কাজ করা রীতিমত চ্যালেঞ্জ। মানুষের মন বুঝে সেই কাজ যাতে ভালোভাবে করা যায় সেই কারণেই 'মনের পাতা'। ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সাধারণ মানুষ ব্লকে কোনও কাজ নিয়ে আসার পরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আধিকারিকরাই তাঁদের বলে দিচ্ছেন, পরিষেবা সংক্রান্ত বা কোনও মতামত বা তাঁদের কোনও কিছু জানাতে হলে বিডিও-র ঘরে গিয়ে 'মনের পাতা'-য় লিখে আসুন। শুধু তাই নয়, এবার থেকে নোটিস বোর্ডেও 'মনের পাতা'-র কথা উল্লেখ থাকবে। যাতে ব্লকে আসা সকলেই তাঁদের অনুভূতির কথা মনের খাতায় পাতায়-পাতায় লিখে আসতে পারেন।
শুধু মনের কথা খাতায় লিপিবদ্ধ নয়। ব্লকে আসা সাধারণ মানুষের সঙ্গে বন্ধু পাতাতে বিডিও একটি করে চকলেটও দিচ্ছেন। যাতে ভয়-ভীতি দূর হয়ে আন্তরিকতা নিয়ে সমস্যার কথা সরাসরি বিডিওকে সহজে বলতে পারেন। 'মনের পাতা'-য় লেখা সমস্যা সমূহ থেকে কাজের পর্যালোচনা করা সহজ হবে বলে মনে করছে ব্লক প্রশাসন। এই 'মনের পাতা'-তেই সম্প্রতি দুলাল মাহাতো নামে একজন এই ব্লকের মানকিয়ারি গ্রাম পঞ্চায়েতের চিতিডি গ্রামের উত্তরা মাহাতো নামে এক বৃদ্ধা মহিলার করুণ কাহিনি লিখেছিলেন। তার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে গিয়ে পদক্ষেপ নেন বিডিও। এভাবেই 'মনের পাতা'-য় লেখা শব্দবন্ধ দিয়ে উন্নয়নের কাজকে ত্বরান্বিত করছে পাহাড়তলি এই ব্লক।