সুমন করাতি, হুগলি: বড় বড় গম্বুজ। গায়ে আলপনা আঁকা। ঠাকুর দালানে তৈরি হচ্ছে দেবী মূর্তি। দেওয়ালে দেওয়ালে শব্দ প্রতিধব্বনি হয়ে ফিরছে কানে। বাড়ির কর্তাদের ব্যবস্তা বাড়ছে। মা আসছেন শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে।
প্রায় সাড়ে ৩০০ বছর আগে পুজো শুরু হয় এই বনেদি বাড়িতে। এই বাড়িতে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। ফলে বলি প্রথা কোনও দিনই ছিল না। আজও নেই। রাজবাড়ির একটি প্রাচীন পুঁথি আছে। সেই পুঁথি মেনে শাস্ত্রমতে এখানকার পুজো অনুষ্ঠিত হয়। পুজোর দিনগুলোতে আগে গান-বাজনার আসর বসত। অতীতে পুজোর সময় এন্টনি ফিরিঙ্গি থেকে ভোলা ময়রারা গান গেয়ে গিয়েছেন। প্রতিদিন আসতেন আসতে বড় বড় ওস্তাদরা। তা নিয়ে গ্রামের বাসিন্দারা ভিড় জমাতেন। সেই বহর নেই। তবে পুজোতে কোনও খামতি রাখা হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন বাড়ির সদস্যরা।
এই রাজবাড়ির পুজো শুরু করেন হরিনারায়ণ গোস্বামী। তবে রাজবাড়ির তার আগেই থেকেই। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই সময় দিল্লির সিংহাসনে আকবর। বাংলার গদিতে আলিবর্দী খান। সেই সময়কালে পাটুলি থেকে এক ব্রাহ্মণ রাম গোবিন্দ গোস্বামী তাঁর স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে নদী পথে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। রামবাবুর স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। হঠাৎ তাঁর প্রসব যন্ত্রণা ওঠে। শ্রীরামপুরের কাছে নামতে বাধ্য হন। রাম গোবিন্দ। নদী তীরবর্তী এলাকা খুব ভালো লেগে যায় তাঁর। সেই সময় শেওড়াফুলির রাজা ছিলেন মনোহর রায়। তাঁরই জমিদারির অধীনে ছিল শ্রীরামপুর। রাজা মনোহর রায় রামগোবিন্দ গোস্বামীকে শ্রীরামপুরে কিছু অংশ দিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকেই শ্রীরামপুরের গোস্বামী রাজাদের পথ চলা শুরু।
এই বাড়ির সঙ্গে রাজনীতি এবং সমাজসেবার একটা যোগ রয়েছে। এই বাড়ির সন্তান তুলসী চরণ গোস্বামী অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এবং তিনি ছিলেন ভারতের পার্লামেন্টের ডেপুটি লিডার। এমনকী তুলসী গোস্বামী উনিশো ২৮ সালে ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টারি কনফারেন্সের ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
এই রাজবাড়িতে বিভিন্ন সময়ে মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসু ,শরৎচন্দ্র বসুর মতন রাজনীতিকের পদধুলি পড়েছে। শুধু রাজনীতির আঙ্গিনায় নয় এছাড়াও এই রাজবাড়ীর দান ধ্যানের সুখ্যাতি তখনকার দিনে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমান শ্রীরামপুর ভবন সেটিও এই পরিবারের দানে তৈরি। এক সময় শ্রীরামপুর পৌরসভার পুরপ্রধান ছিলেন এই বাড়ির সন্তান কানাইলাল গোস্বামী। রাজবাড়ির সামনের গঙ্গা নদী দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে। সেই বহর না থাকলেও পুজোর গরিমা তা এতটুকু ম্লান হয়নি। শ্রীরামপুরের অন্যান্য দুর্গা পুজোর মধ্যে আজও সগৌরবে মাথা উঁচু করে এই রাজ বাড়ির পুজো হয়ে চলেছে।