গোবিন্দ রায়: কথায় বলে, লঘু পাপে গুরুদণ্ড। তাও সই। কিন্তু যদি তা হয় বিনা দোষে… অর্থাৎ কোনও দোষ না করেই দণ্ড? যার এক দিনও জেলে থাকার কথা নয়, সে কি না গারদের অন্ধকারে বিনাদোষেই কাটিয়ে দিল ১৯ বছরের বেশি! সেই মানুষটিকেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে হস্তক্ষেপ করল কলকাতা হাই কোর্ট (Calcutta High Court)। তিনি সুন্দরবনের (Sundarban) চিত্ত বর্মন। অবৈধ অনুপ্রবেশ, অস্ত্র মামলা-সহ একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার (South 24 Parganas) এই মৎস্যজীবী।
প্রথমে বাংলাদেশ নিম্ন আদালত ৩০ বছর সাজা দিলেও পরে দীর্ঘ ১৬ বছর পদ্মাপারে আইনি লড়াই। অবশেষে বেকসুর খালাস ঘোষণা করে মুক্তি দিয়েছিল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ওদেশের আদালত মুক্তি দিলেও আইনি জটিলতায় বর্তমানে বারুইপুর সংশোধনাগারে ১১১ নং বন্দি চিত্ত। সম্প্রতি তাঁকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আদালত বান্ধব তাপসকুমার ভঞ্জ।
[আরও পড়ুন: অর্থের বিনিময়ে রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রায় অভিনেতারা, দাবি বিজেপির, পালটা দিল কংগ্রেসও]
চিত্ত কি সত্যি নির্দোষ? তা নিয়ে তথ্য ও নথি হতে পেতে কলকাতার রেজিস্ট্রার জেনারেলকে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট, রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং ডেপুটি হাই কমিশনের দ্বারস্থ হতে বলল হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ। আদালতের নির্দেশ, বাংলাদেশের দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে বন্দির মুক্তির দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মুক্তি দিয়েছে কি না তা নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে তথ্য-সহ রিপোর্ট দিতে হবে। তাপসবাবু জানান, ‘‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হাতে পাওয়ার পর চিত্ত বর্মনের বিনা দোষে প্রায় কুড়ি বছর কারাবাসে থাকার জন্য ক্ষতিপূরণের আবেদন জানাব আদালতে। বিনা অপরাধে তাঁর প্রত্যেকটি দিন কারাগারে কাটানোর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’’
আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৩ সালে একদল মৎস্যজীবীর সঙ্গে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন চিত্ত। এক রাতে চিত্তরা যখন মাঝনদীতে জাল টানছিলেন, ঠিক সে সময় জলদস্যুদের কবলে পড়ে যান তাঁরা। তাঁদের অপহরণ করে ওই জলদস্যুরা। এটুকুই মনে করতে পারেন চিত্ত বর্মন। পরের দিন যখন জ্ঞান ফেরে তখন তিনি বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের হেফাজতে। সঙ্গীদের কোনও খোঁজ নেই। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে কোস্ট গার্ডের আধিকারিকদের গোটা বৃত্তান্ত খুলে বললেও পরবর্তীকালে চিত্তকে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে তারা। বেআইনি অনুপ্রবেশ, অস্ত্র মামলা-সহ একাধিক অপরাধের ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়।
[আরও পড়ুন:কেটে টুকরো টুকরো করবে আফতাব! দু’বছর আগেই পুলিশকে জানান শ্রদ্ধা, প্রকাশ্যে বিস্ফোরক চিঠি]
এদিকে, ওই দলের বেশ কয়েকজন মৎস্যজীবীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। বেশ কয়েক মাস অপেক্ষার পর চিত্তর খোঁজ না মেলায় স্ত্রী শিবানী ধরেই নিয়েছিলেন স্বামী মারা গিয়েছেন। প্রায় ১৩ বছর পর হঠাৎ স্বামীর খোঁজ পান শিবানী দেবী। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যে বন্দি প্রত্যর্পণ হয়, তাতে ওপার থেকে বেশ কয়েকজন সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন বন্দিকে এপারে ফেরত পাঠানো হয়। যার মধ্যে ছিলেন চিত্ত বর্মনও। রাজ্যে আসার পর তাঁর ঠিকানা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের বন্দিদের পরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বারুইপুর সংশোধনাগারে। সেখানেই এখন দিন কাটছে চিত্ত বর্মনের। তবে এবার তাঁর মুক্তির আশায় দিন গুনছেন চিত্ত বর্মন ও তাঁর পরিবার।
রাজ্যের সংশোধনাগারগুলিতে কারাগৃহের তুলনায় বন্দির সংখ্যা বেশি হওয়ায় ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে থাকতে হয় বন্দিদের। পরিকাঠামোগত ত্রুটিও রয়েছে। করোনা পরিস্থিতির প্রাক্কালে এমনই রিপোর্ট হাতে পাওয়ায় করোনায় প্রত্যেকটি রাজ্যের সংশোধনাগার থেকে বন্দির চাপ কমাতে আগেই উদ্যোগ নিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। কার্যকর করতেও প্রত্যেকটি রাজ্যের হাই কোর্টকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের তরফে। উদ্যোগী হয় কলকাতা হাই কোর্টও। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব অথবা মুখ্য সচিব, রাজ্যের লিগ্যাল এড সার্ভিস অথরিটি বা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং কারা বিভাগের মুখ্যসচিবকে নিয়ে হাই কোর্টের একটি কমিটি গঠিত। এছাড়াও স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় আইনজীবী তাপস ভঞ্জকে আদালত বান্ধব নিযুক্ত করে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।
তাপসবাবু রাজ্যের সব সংশোধনাগার পরিদর্শন করেন। বারুইপুর সংশোধনাগারে গিয়ে চিত্ত বর্মনের বিষয়টি নজরে আসে তাঁর। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, চিত্ত বর্মন প্রায় ২০ বছর জেলে থাকলেও ২০১৯ সালের ১৮ জুন তাঁকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।