বিক্রম রায় ও রাজ কুমার: কারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে ৩০ বছর আগে। কেউ আবার ২০ বছর আগে বিয়ে হয়ে অসমে গিয়েছেন। কিন্তু খসড়া তালিকায় নাগরিক পঞ্জিতে তাঁদের নাম নেই। আর তা দেখে বাপেরবাড়ি ফেরার জন্য কান্নাকাটি জুড়েছেন বাংলার মেয়েরা। রবিবার দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই অনেকে আলিপুরদুয়ারে বাপেরবাড়ি চলেও এসেছেন। বিদেশিনী তকমা পাওয়ার আতঙ্কে তাঁরা দিশেহারা। নাগরিক পঞ্জিতে নাম না ওঠার কারণে অনেকেই আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন।
[আরও পড়ুন:‘গুজবে কান দেবেন না’, NRC ইস্যুতে গোর্খাদের আশ্বাস দার্জিলিংয়ের সাংসদের]
একই হাল বক্সিরহাট সংলগ্ন অসমের ধুবড়ি জেলার গ্রাম ছোটগুমাতেও। এই গ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবারের বধূ কোচবিহারের। প্রায় সকলেরই নাম বাদ পড়েছে তালিকা থেকে। গ্রাম জুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। দিনরাত অসম-বাংলা সীমানার বিভিন্ন এলাকায় এই নিয়েই চলছে আলোচনা-বৈঠক। কীভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে, চলছে সেই সমাধান সূত্র খোঁজা। তবে সমস্যা যে হচ্ছে, তা কিন্তু স্বীকার করছে আলিপুরদুয়ারের বিজেপি-তৃণমূল দুই শিবিরই।
অসম-বাংলা সীমানার পাকড়িগুড়িতে বাড়ি সুকুমার বর্মনের। ৩০ বছর আগে অসমের গোঁসাইগাওয়ের গুড় খেলা কানুপাড়াতে বিয়ে দিয়েছেন বোন কৃষ্ণার। কৃষ্ণার তিন মেয়ে, দুই ছেলে। সকলেরই বিয়ে হয়েছে অসমে। সকলের নাগরিক পঞ্জিতে নাম রয়েছে। নাম নেই শুধু কৃষ্ণাদেবীর। নাগরিক পঞ্জি প্রকাশের পর থেকেই কেমন যেন এই পৃথিবীতে একা হয়ে গিয়েছেন কৃষ্ণা। টেলিফোনে সবসময় কান্নাকাটি করছে বলে জানিয়েছেন পাকড়িগুড়িতে থাকা দাদা সুকুমার। আতঙ্কে গোঁসাইগাওয়ের স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাংলা-অসম সীমানা লাগোয়া অসমের শ্রীরামপুরে মেয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছেন কৃষ্ণা। কিন্তু এই বয়সে বাপেরবাড়ি এলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? এত দিনের সংসার, বাড়িঘর ছাড়বেন কিভাবে কৃষ্ণা? সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সীমানার এপার আর ওপারের দুই পরিবারে।
অন্যদিকে, ছোটগুমা গ্রামে প্রায় কুড়ি বছর আগে বিয়ে হয়েছে তুফানগঞ্জের ভানুকুমারি সখিনা বিবির। তাঁর কথায়, দুই সন্তান, স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি সকলের নাম এনআরসির তালিকা উঠেছে। শুধু ওঠেনি তাঁর নাম। যেহেতু কোচবিহার শহরের ১৯৬৬ সালের ভোটের কোনও নথি নেই, তাই কলকাতা থেকে সার্টিফাইড কপি নিয়ে এসে জমা দিয়েছিলেন। দেওয়া হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার সময়ের দাদুর জমির দলিল। তবে কাজ হয়নি। এবারও নাম ওঠেনি।
একইভাবে পাকড়িগুড়ির শম্ভু বর্মনের স্ত্রী সোনামনি বর্মনের দিদি টুপুরি বর্মনের ১৯ বছর আগে অসমের শ্রীরামপুরে বিয়ে হয়েছে। সোনামনিদের বাপেরবাড়ি ছিল কোচবিহার জেলার সাতভলকা এলাকায়। অনেকেই বুঝতে পারবেন না শ্রীরামপুর আর কোচবিহারের সাতভলকা দুই গ্রাম দুই রাজ্যে অবস্থিত। শুধু এপার আর ওপার। কিন্তু এখন যেন দূরত্ব হয়েছে শতযোজন। এদিন তাই এপারের পাকড়িগুড়ির সুকুমার বর্মন বলেন, “সব কাগজ দিয়েছি। তাও বোনের নাম উঠল না। বাবার জমির কাগজ থেকে ভোটার তালিকা সব দিয়েছি। তাও নাম উঠল না। আদালতে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”
[আরও পড়ুন:নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকানে ঢুকে পড়ল লরি, সিভিক ভলান্টিয়র-সহ মৃত ৪]
আলিপুরদুয়ার জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত রায় বলেন, “নাগরিক পঞ্জি নিয়ে অযথা আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে।” আলিপুরদুয়ার জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি মৃদুল গোস্বামী অবশ্য বলেন, “এই বিষয়ে যা বলার কেন্দ্রীয় নেতারাই বলবেন। তবে অসম থেকে কেউ এই রাজ্যে কোনও অসুবিধায় পড়লে তাঁদের সঙ্গে আমরা অতিথিদের মতোই আচরণ করব।” আলিপুরদুয়ার জেলার পুলিশ সুপার নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠী বলেন, “সীমানা এলাকায় কোথাও কোনও অশান্তি নেই। অসম-বাংলা সীমানায় চেকিং চলছে। অসম থেকে যে কেউ বাংলায় কারও আত্মীয়ের বাড়িতে আসতেই পারেন। তাতে কোনও অসুবিধা নেই।”
The post নাম নেই অসমের এনআরসিতে, স্বামী-সংসার ছেড়ে ঘরে ফিরতে চায় এরাজ্যের মেয়েরা appeared first on Sangbad Pratidin.
