কৃষ্ণকুমার দাস: কৃষি সমবায় নির্বাচনে নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিজেপি গোহারা। আর তাতেই রাজ্য বিজেপির সিংহভাগের মধ্যে খুশির হাওয়া। রীতিমতো উল্লসিত দিলীপ ঘোষ ও সুকান্ত মজুমদার শিবির। রাজ্য কমিটির অধিকাংশ নেতা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় শুভেন্দুর ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির’ তীব্র সমালোচনা করেন। শুধু তাই নয়, বিরোধী দলনেতার উদ্যোগে সমবায় ভোটে রাম-বাম জোট করেও গোহারা হওয়ায় বিজেপির ভাবমূর্তির যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে স্বীকার করেন একাধিক রাজ্য নেতা।
দিলীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ এক রাজ্য নেতা প্রকাশ্যেই বলেন,”দল ও সংগঠন বাদ দিয়ে শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক (শুভেন্দুকে ঘিরে) রাজনীতি করতে গিয়েই নন্দীগ্রাম তথা পূর্ব মেদিনীপুরে একের পর এক সমবায় ভোটে বিজেপি হারছে। এতদিন ধরে যেভাবে নন্দীগ্রামকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে তা যে পুরো শূন্য কলসি তা সমবায় ভোটে প্রমাণ হয়ে গেল। বিরোধী দলনেতার ক্যারিশমা যে পুরো তলানিতে তা তথাকথিত বিজেপির ভোটব্যাংক ছিল এমন গ্রামে পদ্মশিবিরের ১২-০ ফলে হার গোটা বাংলায় প্রভাব ফেলবে।” রাজ্য কমিটির এক প্রবীন ও আদি বিজেপি নেতা নাম না করেও সরাসরি শুভেন্দুকে কটাক্ষ করে বলেন, “মুখে শুধু বড় বড় কথা, তারিখ দিয়ে হুংকার মারলেও নিজের কেন্দ্রেই পার্টির পতাকা ধরে রাখতে পারছেন না। মিথ্যা আশ্বাস ও কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দিল্লির দু’একজন শীর্ষ নেতাকে তুষ্ট করে বেশিদিন বিরোধী নেতার পদ যে ধরে রাখা যাবে না তা নন্দীগ্রামের ফলে বোঝা গিয়েছে।” অবশ্য সুকান্ত মজুমদারের অনুগামী এক বিধায়ক এদিন স্পষ্ট অভিযোগ করে বলেন,”নিজের ঘর সামলাতে পারছে না আবার সুকান্তদার চেয়্যার নিয়ে টানাটানি করছিল। পঞ্চায়েত ভোটে নন্দীগ্রামের দুই ব্লকে পদ্ম প্রতীক বাঁচাতে এখনই মুখ বন্ধ করে বিরোধী দলনেতার এলাকায় থাকা উচিত।’’
[আরও পড়ুন: এখনই আন্তর্জাতিক বিমান বন্ধ নয়, বলছেন বিশেষজ্ঞরা, বিমানবন্দরে RT-PCR টেস্টের নির্দেশ কেন্দ্রের]
নিজেদের দল ও সংগঠনের উপর ভরসা না করে এবং আরএসএসকে উপেক্ষা করে কংগ্রেস ও বামেদের সঙ্গে জোট করে সমবায় ভোটে নামায় শুভেন্দুর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন আদি বিজেপি নেতারা। মুরলীধর সেন লেনের বৈঠকে এদিন অংশ নেওয়া এক প্রবীন নেতার কথায়, “জেলায় নিচুতলায় রাম-বাম জোট গেরুয়া ভোটব্যাংকের যথেষ্ট ক্ষতি করছে। তবে পুরানো নেতাদের উপেক্ষা করে হার আটকাতে শুভেন্দুর নেতৃত্বে রাম-বাম জোট গড়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে পূর্ব মেদিনীপর জেলা থেকে। এই জোট গড়েও তো নন্দীগ্রামে হার আটকাতে পারল না।” দিলীপ ঘনিষ্ঠ এক সাংসদের কটাক্ষ,”দলের পুরানো কর্মীদের মর্যাদা না দিয়ে শুধুমাত্র একজনের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি করলে নন্দীগ্রামের মতো এমন আরও গোহারের জন্য বিজেপিকে প্রস্তুত থাকতে হবে।” ১২-০ ফলে নন্দীগ্রামের ভেটুরিয়া কৃষি সমবায়ের ভোটে শুভেন্দুর গোহারা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের প্রতিক্রিয়া, “নন্দীগ্রামের মানুষকে কিছুদিনের জন্য বিভ্রান্ত করা শুভেন্দুর পায়ের তলা থেকে মাটি পুরোপুরি সরে গিয়েছে। বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস জোট করেও কৃষি সমবায় ভোটে শূন্য হয়ে পদ্মশিবির। আর হারছে বুঝতে পেরেই মরিয়া হয়ে বহিরাগত দুষ্কৃতিদের নন্দীগ্রামে ঢুকিয়ে হামলা করেও ভোকাট্টা হয়েছ গিয়েছে লোডশেডিংয়ে জেতা বিধায়ক।”এদিন তমলুকের নিমতলায় এক নার্সিংহোমে ভেটুরিয়ার সমবায় ভোটে আহত তিন বিজেপি কর্মীকে দেখতে যান শুভেন্দু অধিকারী। পরে অভিযোগ করেন, শাসকদলের হামলায় এই কর্মীরা আহত হয়েছেন।
নন্দীগ্রাম-২ ব্লকের ভেটুরিয়া সমবায় দলের প্রার্থীরা জয়ী হওয়ায় এদিন বিকেলে নন্দীগ্রাম-১ ব্লকে ‘ধন্যবাদজ্ঞাপক ও অভিনন্দন’ জানিয়ে বিশাল মিছিল করে তৃণমূল কংগ্রেস। নেতৃত্বে ছিলেন নন্দীগ্রাম-১ ব্লক সভাপতি বাপ্পাদিত্য গর্গ। সঙ্গে ছিলেন সমবায়ে জয়ী দলীয় প্রার্থীরা। বিজেপির দুষ্কৃতীদের হামলায় জখম নন্দীগ্রামের দলীয় নেতা মতিউর রহমান খানকে দেখতে এদিন দুপুরেই তমলুক হাসপাতালে পৌছান তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। মাথায় ১২টি সেলাই পড়ায় ইতিমধ্যে সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। স্বভাবতই তঁার চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল সুপার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদেরও সঙ্গেও কথা বলেন কুণাল। বিজেপির হামলায় জখম আরও কয়েকজন তৃণমূল কর্মীর সঙ্গেও কথা বলেন তৃণমূল মুখপাত্র। দলীয় কর্মীদের জখম হওয়া নিয়ে কুণাল বলেন, “আমরা বিজেপির মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করি না, প্ররোচনামূলক কথাটা বলি না। আমরা বলি এক গালে মারলে আরেক গাল বাড়িয়ে দাও। এখন মাটি কামড়ে থাকো, ভোটটা জিততে হবে। তাই তো আমাদের ছেলেরা মাথা ফাটিয়ে শুয়ে আছে। আর তাঁদের দেখতে আসতে হচ্ছে।’’
[আরও পড়ুন: বছর শেষে পাক নাশকতার ছক বানচাল, কাশ্মীরে উদ্ধার প্রচুর অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র]
পরে জেলা তৃণমূল দপ্তরে সংগঠনের সভাপতি ডঃ সৌমেন মহাপাত্র এবং নন্দীগ্রাম-১ ও ২ ব্লক সভাপতিদের নিয়ে পরবর্তী দলীয় পদক্ষেপ নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠক শেষে নন্দীগ্রাম নিয়ে একগুচ্ছ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তৃণমূল মুখপাত্র। কুণাল জানান,‘‘আগামী ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর সমবায় ভোটে বিজেপির হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের দাবিতে আইসির মাধ্যমে পুলিশ সুপারকে ডেপুটেশন দেওয়া হবে।” এরপর যে ভেটুরিয়ার সমবায় ভোটে ১২-০ ফল হয়েছে সেখানেই আগামী ২৭ ডিসেম্বর ‘অভিনন্দনজ্ঞাপক সভা’ করবে তৃণমূল। বক্তা থাকবেন দলের রাজ্য সহসভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার ও তমলুক জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌমেন মহাপাত্র।