shono
Advertisement

‘বনপার্টি’র ডাক আজও কানে বাজে, মেয়েকে হারিয়েও জঙ্গলমহলের দিন বদলে ভোটবাক্সই ভরসা

ঝাড়গ্রামে কয়েক বছর আগেও 'বনপার্টি'র ডাকে বেরিয়ে আর ঘরে ফেরেননি কেউ।
Posted: 04:53 PM Mar 26, 2021Updated: 07:41 PM Mar 26, 2021

সুমিত বিশ্বাস ও সুনীপা চক্রবর্তী, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রাম: শ্রীকান্ত হাটুই, ধরণী মাহাতো, অনিমা বেসরা – জঙ্গলমহল (Jangalmahal) জুড়ে এই তালিকাটা দীর্ঘ। আজ এক দশকের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও তারা রাজ্য পুলিশের খাতায় ‘নিখোঁজ’। অথচ একাধিক ক্ষেত্রে বনপার্টিরাই বাড়িতে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়ে দেয় পুলিশের ‘চর’ সন্দেহে খুন করা হয়েছে তাঁদের। কিন্তু ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ মেলেনি। ফলে সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় থাকেন স্ত্রী। বাবার অপেক্ষায় থাকে ছেলে। মেয়ের জন্য জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষাই করতে থাকেন মা।

Advertisement

অনিমা বেসরার মা চূড়ামণি। ছবি: অমিত সিং দেও

ঝাড়গ্রামের (Jhargram) বিড়িহাড়ি, লালগড়ের গোহমিডাঙা, জামবনির বুড়িশোল। এই জঙ্গলেই পুলিশের চর সন্দেহে গুলি করে লাশ লোপাট করে দেওয়া হত! এই জঙ্গল থেকেই যে গামছার আড়ালে চলত লুকোচুরি খেলা। চলত জঙ্গলমহলে প্রশাসনের সমান্তরাল ‘শাসন’। কিন্তু আজ আর সেই চোখরাঙানির ‘শাসন’ নেই। প্রায় এক দশক আগে বুড়িশোলের জঙ্গলে যৌথ বাহিনীর চক্রব্যূহে বন্দি হয়ে তিনি নিহত হওয়ার পর জঙ্গলমহল এখন আপাতত শান্ত। কিন্তু এই বুড়িশোল, গোহমিডাঙার পাশে দাঁড়ালে এখনও হাড়হিম আতঙ্ক গ্রাস করে। ঢালাই রাস্তা, কালভার্টে পথ আর দুর্গম না থাকলেও জঙ্গলমহলের এই নিবিড় বনভূমি ‘অভিশপ্ত’ হয়েই রয়েছে। বুড়িঝোরে সন্ধের শেষে জঙ্গল পথ দিয়ে পার হলে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে যেন কানে তালা পড়ে।

[আরও পডুন: জঙ্গলমহলে ‘বহিরাগত’দের একাই রুখবেন মমতা, প্রকাশ্যে ‘ফাইটার দিদি’র দ্বিতীয় ভিডিও]

২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর। তার আগের দু’দিন ধরে গুলির লড়াই এখনও চোখের সামনে ভাসে বুড়িশোলের, গোহমিডাঙার। এই বুড়িশোলেই যে নিহত হন কিষানজি ওরফে মাল্লেজুল্লা কোটেশ্বর রাও। তারপর থেকেই অপহরণ, পুলিশের চর সন্দেহে খুন, রাস্তা কেটে আন্দোলন, বন্‌ধে আপাতত দাঁড়ি। কিন্তু অনিমা, শ্রীকান্ত, ধরণীরা ফিরে আসেন না। মেলেও না দেহও। তাই বদলে যাওয়া জঙ্গলমহলে এখনও স্বজনকে খোঁজে তাঁদের পরিবার। প্রশাসন তথা সরকার ধরেই নিয়েছে এই শ্রীকান্ত, ধরণীরা আর ফিরবেন না। তাই নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের পুলিশে চাকরি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বজন হারানোর বেদনা ক্ষতের মতো রয়েই গিয়েছে। তাই ভোট এলেই অশক্ত শরীরেও উঠে দাঁড়ান তাঁরা। যতই ‘বয়কট’-এর ডাক থাক, ভোটার কার্ড হাতে জবাব দিতে প্রস্তুত। আশা একটাই, আর যেন সেই অতীত না ফেরে।

[আরও পডুন: ‘কেউ যেন হেঁটে ফিরে যেতে না পারে’, তৃণমূলী ‘গুন্ডা’দের পালটা দেওয়ার নিদান দিলীপের]

আজ ঝাড়গ্রামের লালগড়ের বাঁকিশোলের দুধ বিক্রেতা শ্রীকান্ত ওরফে রাজু হাটুইয়ের স্ত্রী বনলতা পুলিশে চাকরি পেয়েছেন। বনলতা বলেন, “২০১০ সালের অক্টোবর মাস। সেই সকালে দুধ বিক্রি করতে গিয়েছিলেন মানুষটা। তারপর আর ফেরেননি। পাশের জঙ্গল থেকে শুধু ওর হাওয়াই চটিটা মিলেছিল। কী অপরাধ ছিল বলতে পারেন?” এই প্রশ্ন নিয়েই পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন তিনি। ঝাড়গ্রাম থানার ঘৃতখাম। বাড়ি থেকে ডেকে নিরীহ চাষি ধরণীকে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ওই বনপার্টিরা। তারপর আর কোনও খোঁজ নেই। কিছুদিন পর মাও কমান্ডারের বার্তা এসেছিল – ‘পুলিশের চর। তাই গণআদালতে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’ একইভাবে এক দশক আগের সন্ধে সাতটাতেই দরজায় কড়া নেড়েছিল বনপার্টিরা। ভয়ে দরজা খুলে দিতেই অণিমার খোঁজ। তারপর ওর কাকার। দু’জনকেই পিছমোড়া করে বেঁধে গ্রামের দু’দিকে নিয়ে যায় ওরা। পরের দিন সকালে গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে কাকা নন্দ বেসরার মৃতদেহ উদ্ধার হলেও অণিমার খোঁজ নেই। ‘নিখোঁজ’ হয়েই রয়ে গিয়েছেন পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের রাজাউলির অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী অনিমা বেসরা।

অনিমার মা চূড়ামণি বলেন, “মেয়েটা বেঁচে নেই – এটা বিশ্বাসই করাতে পারি না মনকে। মনে হয়, ঠিক একদিন ফিরে আসবে।” তাই ফিরে আসার অপেক্ষাতেই ভোট দেন। এবারও নিজের ভোট দিতে যাবেন বুথে। বুথের ধুলো রাস্তা ঢালাই হয়েছে। নলকূপ থেকে সবসময় জল মেলে। কিন্তু বদলে যাওয়া জঙ্গলমহলে এখনও মায়ের কানে বাজে দশ বছর আগের রাতের সেই কথা, “অনিমা কোথায়? আমরা বনপার্টি।”

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup রাজধানী এক্সপ্রেস toolbarvideo ISL10 toolbarshorts রোববার